
ঝিনুকের মতো দেখতে নান্দনিক একটি স্থাপনা। গ্লাসের দেয়াল আর স্টিলের আবরণে বাইরের অংশ চকচকে। দৃষ্টিনন্দন নকশার ভবনটি নজর কড়ে খুব সহজেই। বাংলাদেশের ক্রিকেট অবকাঠামোয় অনন্য সংযোজন চট্টগ্রামের বীরশ্রেষ্ঠ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান স্টেডিয়ামের এই ইনডোর। তবে আলোর নিচে যেমন থাকে অন্ধকার, সৌন্দর্যময় এই ইনডোরের ভেতরটাতেও তেমনি প্রতিধ্বনিত হচ্ছে অপূর্ণতার হাহাকার।
দেশের মূল তিন আন্তর্জাতিক ভেন্যুর মধ্যে মিরপুর আর সিলেটের ইনডোর নিয়মিত ব্যবহারে ব্যস্ত থাকে। চট্টগ্রামের ইনডোরেও একসময় ব্যাট-বলের ঝংকার উঠত নিয়মিত। কিন্তু সেই ইনডোর ভেঙে ফেলা হয়েছে বেশ আগেই। তার পর অনেকটা সময় নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে নতুন এই ইনডোর। এখানে অনুশীলনও শুরু হয়েছিল কিছুটা। তাতেই বেরিয়ে এসেছে ভেতরের কঙ্কাল।
সেই ২০১৯ সালে এই ইনডোরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছিল। কাজ শুরু হয় পরের বছর। পরে কাজ শেষ করতে সময় লেগে যায় ধারণার চেয়ে বেশি। তাতে দীর্ঘদিন এখানে ইনডোর সুবিধা ব্যবহার করা যায়নি। ২০২৩ সালে এটি উদ্বোধন করা হলেও তখনও মূলত ব্যবহার উপযোগী ছিল না। এরপর টুকটাক ব্যবহার শুরু হতেই বেরিয়ে আসে, নয়নাভিরাম এই স্থাপনের ভেতরটায় আসলে অনুশীলনে গেলে ওষ্ঠাগত হয়ে ওঠে প্রাণ। দম বেরিয়ে যায় ক্রিকেটারদের!
প্রচলিত প্রবাদটিই মনে পড়ে তাতে, ‘বাইরে ফিটফাট, ভেতরে সদরঘাট।’

চট্টগ্রামে বাংলাদেশ-ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজের ফাঁকে এই ইনডোরের প্রবেশদ্বার দিয়ে সামনে এগিয়ে দেখা গেল, গ্লাসের দরজায় বাইরে থেকে একটি লোহার তালা ঝুলছে। মরিচার আস্তরণ জানিয়ে দিচ্ছে, অনেক দিন কোনো হাতের স্পর্শ পড়েনি এখানে। দরজায় ঝুলছে সাদা কাগজে লেখা একটি নোটিশ। বিসিবির সিনিয়র ন্যাশনাল ম্যানেজার সৈয়দ আব্দুল বাতেন এবং স্টেডিয়ামের ভেন্যু ম্যানেজার ফজলে বারি খান রুবেলের স্বাক্ষরে সেখানে লেখা, ২০২৪ সালের দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজ ও জাতীয় ক্রিকেট লিগ উপলক্ষে নির্দিষ্ট খেলোয়াড় ছাড়া অন্যের প্রবেশ নিষেধ।
নোটিশে ধুলো, চারপাশে ধুলো। বুঝতে বাকি থাকে না, ব্যবহার নেই বললেই চলে। ভেতরের পরিবেশও সেটাই প্রমাণ করে। কাঁচে মুখ ঠেকিয়ে দেখতে পাওয়া গেল, নতুন জায়গার সেই প্রাণখোলা দৃশ্যের অনুপস্থিত। বরং সেখানে মিশে আছে স্থিরতা আর ব্যবস্থাপনায় অবহেলার ছাপ।
ইনডোরে ব্যবহারের জন্য আনা টার্ফ রোল করে তুলে রাখা হয়েছে প্রবেশদ্বারে। গত বছরের টার্ফও নাকি ছিল ক্রুটিযুক্ত।
এমন বাস্তবতায় বিসিবির একাধিক কর্মকর্তার কাছ থেকে জানা গেল, সমস্যার আসলে আরও গভীরে। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে আলাপচারিতায় বিসিবির পরিচালক এই চট্টগ্রামেরই সংগঠক মঞ্জুর আলমের কণ্ঠে আক্ষেপের সুর স্পষ্ট।
‘‘বিসিবি নির্বাচনের আগে বুলবুল ভাই (বিসিবি সভাপতি আমিনুল ইসলাম) চট্টগ্রামে এসেছিলেন মাঠ পরিদর্শনে। আমি দেখেছি, তিনি খুব খুশি ছিলেন। তবে শুধু খুশি হলেই হবে না, সবাই দেখে যায়, কিন্তু কাজ হয় না। ইনডোরে মান উন্নয়নের যে কাজগুলো দরকার, সেগুলো খুব বড় কিছু নয়; কিন্তু সেই কাজটাই হচ্ছে না। অথচ একটু উদ্যোগ নিয়ে সমস্যাগুলো দেখলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।’’
‘‘এখানে কিছু টেকনিক্যাল কাঠামো দরকার। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে জাপানি নির্মাণ সংস্থা জাইকা এটি করেছে। ওদের নকশায় ত্রুটি আছে, এজন্য ক্রিকেটারদের ব্যবহার করতে সমস্যা হচ্ছে। নকশার ত্রুটির কারণে ভেতরে প্রচুর গরম লাগে, ক্রিকেটাররা ঘেমে যায়, ঠিকমতো অনুশীলন করতে পারে না। এখানে অবশ্যই এক্সস্ট ফ্যান লাগবে। মূলত ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা রাখা হয়নি, ভেতরে বাতাস ঢোকে না। ছোট ছোট দুইটা পাখা এক প্রান্তে। এত গরমের মধ্যে এখানে এসি দিলেও সমস্যা রয়েই যাবে। ডিজাইনটা দেখতে সুন্দর হলেও আসলে ত্রুটিতে ভরা।’’

জাপানি উন্নয়ন সংস্থা জাইকার অর্থায়নে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনায় এই ইনডোর নির্মিত। ক্রিকেটে তাদের এই সংযোগের কারণটা আদতে বাধ্য হয়েই। জাপানের জাইকা এবং বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে বিপুল ব্যয়ে এই স্টেডিয়ামের পাশ ঘেঁষেই তৈরি করা হয়েছে পতেঙ্গা-ফৌজদারহাট আউটার রিং রোড। ৩ নম্বর ফিডার রোডটি স্টেডিয়ামের পাশ দিয়ে নগরীর পোর্ট কানেক্টিং রোডের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। সাগরপাড় থেকে আসা এই রাস্তাটি সাগরিকা রোডের সাথে যেখানে যুক্ত হয়েছে, সেখানে ছিল এই স্টেডিয়ামে আগের ইনডোর। রাস্তার প্রয়োজনে তা ভেঙে ফেলতে হয়েছে। এজন্য তারাই তৈরি করে দিয়েছে নতুন ইনডোর।
আনুষ্ঠানিকভাবে খরচের অঙ্ক বলা না হলেও নানা সূত্রে বিভিন্ন সময়ে খবর প্রকাশিত হয়েছে, প্রায় ১২ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে ইনডোরটির নির্মাণ ও অন্যান্য কাজ মিলিয়ে। কিন্তু ভেতরের বড় ত্রুটির কারণে সেই ইনডোরের সুফলই মিলছে না!
বিসিবি পরিচালক মঞ্জুর আলম ক্ষোভের সুরেই বললেন, অতি সহজে এই ইনডোর বিসিবি পেয়ে গেছে বলেই গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না।
‘‘এখানে যে ধরনের কাজ দরকার, তা এক মাসের বেশি লাগবে না। আমি তো এটার দায়িত্বে নেই। দায়িত্বে থাকলে ডিজাইনার এনে ত্রুটিগুলো দ্রুত সারানোর চেষ্টা করতাম। কিছু গ্লাস খোলা রাখা হয়েছে বাতাস প্রবাহের জন্য। এটা আমরা ফ্রি পেয়েছি বলেই সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারছি না। এটা যদি আমাদের টাকায় হতো, তাহলে ঠিকই ব্যবহার হতো। এটা মাগনা পেয়েছি তো.. তাই সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারছে না। এটা যদি আমাদের পয়সায় হতো, তাইলে ঠিকই ব্যবহার হতো।’’
বিসিবি পরিচালক ও ফ্যাজিসিলিজ বিভাগের নতুন চেয়ারম্যান শানিয়ান তানিম নাভিন আশ্বাস দিলেন, শিগগিরই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করবেন তারা।
‘‘আমি বিপিএলের ভেন্যু পরিদর্শনের অংশ হিসেবে দেখতে গিয়েছিলাম এখানে। ইনডোরের ব্যবহার বাড়াতে কিছু চাহিদা আছে। আমি দেখেছি। চাহিদা যাচাই বাছাই করে দ্রুত সমাধান করা হবে। যেখানে যেখানে সমস্যা বা ফ্যাসিলিটিজ বাড়াতে হবে, আমি দায়িত্ব পাওয়ার পর সেখানে নজর রাখছি। সমাধানের চেষ্টা করছি। ইনডোরের জন্য যে সমস্যাগুলো আছে, আশা করি দ্রুত সেগুলো সমাধান করা হবে।’’
দীর্ঘদিন ধরে এখানকার ভেন্যু ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসা ফজলে বারি খান রুবেল অবশ্য এটিকে বড় সমস্যা হিসেবে দেখছেন না।
‘‘অস্ট্রেলিয়া থেকে আনা টার্ফ এই ইনডোরে সম্প্রতি ইনস্টল করেছে বিসিবি। সুযোগ ও চাহিদা মতো ব্যবহারও হচ্ছে। সমস্যা শুধু ভিতরে এক্সস্ট ফ্যান নিয়ে। দুটো আছে ফ্যান, যেগুলো সিডিএ (চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ) স্থাপন করেছিল। সেগুলো সাইজে খানিকটা ছোট। কারখানায় ব্যবহার করা হয় যেগুলো, এমন ইন্ডাস্ট্রিয়াল আরও চারটি ফ্যান দরকার। বিসিবির নতুন ফ্যাসিলিটিজ চেয়ারম্যান নাকি এটা দেখেছেন, দ্রুত চারটি পাখা স্থাপনের আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।’’
আপনার মতামত লিখুন :