
সেই একই উইকেট তো? ম্যাচের শুরুতে ধন্দে পড়তে হলো। সময়ের সঙ্গে বাড়তে থাকল বিস্ময়। যে সিরিজের আগের দুই ম্যাচ ছিল ব্যাটসম্যাদেন জন্য বধ্যভূমি, যে উইকেট ছিল ব্যাটিংয়ের জন্য বিভীষিকার, সেখানেই এবার স্ট্রোকের ফুল ফোটালেন সৌম্য সরকার ও সাইফ হাসান। দুজনের রেকর্ড জুটির পথ ধরে রানের যে সৌধ গড়ল বাংলাদেশ, এর চাপায় পিষ্ট হলো ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
আগের ম্যাচটি ছিল যতটা নাটকীয়, এই ম্যাচ হলো ততটাই ম্যাড়ম্যাড়ে। শেষ ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ১৭৯ রানে গুঁড়িয়ে তিন ম্যাচের সিরিজ ২-১ ব্যবধানে জিতে নিল বাংলাদেশ।
ওয়ানডেতে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সেরা জয় এটি। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে এটিই রেকর্ড। এর চেয়ে বড় জয় আছে কেবল আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ২০২৩ সালে ১৮৩ রানে।
এই জয়ে টানা চার সিরিজ হারার পর একটু স্বস্তির ছোঁয়া পেল বাংলাদেশের ওয়ানডে দল। র্যাঙ্কিংয়ে অবশ্য পড়ে থাকতে হচ্ছে সেই ১০ নম্বরেই।
মিরপুর শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামে বৃহস্পতিবার বাংলাদেশকে দুর্দান্ত শুরু এনে দেন সৌম্য ও সাইফ। ১৭৬ রানের রেকর্ড উদ্বোধনী জুটি গড়েন দুজন। পরের সময়টায় প্রত্যাশিত পথে এগোয়নি দলের ইনিংস। তার পরও ৫০ ওভারে ২৯৬ রান তোলে বাংলাদেশ।
উইকেট যে আসলে ব্যাটিংয়ের জন্য খুব আদর্শ নয়, তা প্রমাণ হয়ে যায় ম্যাচের পরের ভাগেই। সামান্যতম লড়াই করতেও পারেনি ক্যারিবিয়ান ব্যাটসম্যানরা। স্রেফ ৩০.১ ওভারেই তাদের ইনিংস শেষ হয় ১১৭ রানে।
বাংলাদেশের চার স্পিনার মিলেই শেষ করে দেন খেলা। ওয়ানডেতে এই নিয়ে দ্বিতীয়বার স্রেফ স্পিন দিয়েই ১০ উইকেট নিতে পারল তারা। তবে পেসারদের বল হাতে নেওয়া ছাড়াই প্রতিপক্ষকে অলআউট করার নজির বাংলাদেশের এটিই প্রথম।
উইকেট যে আসলে ব্যাটিংয়ের জন্য খুব আদর্শ নয়, তা প্রমাণ হয়ে যায় ম্যাচের পরের ভাগেই। সামান্যতম লড়াই করতেও পারেনি ক্যারিবিয়ান ব্যাটসম্যানরা। নিয়মিত
এই উইকেটেই সিরিজের প্রথম ম্যাচে ভুগেছিল দুই দলের ব্যাটসম্যানরা। এ দিন উইকেট ছিল সেই ম্যাচের তুলনায় একটু ভালো। টার্ন মিলেছে যথারীতি, তবে ম্যাচের শুরুতে বাউন্স ছিল ভালো, নতুন বল ব্যাটে এসেছে ভালোভাবে।

সৌম্য ও সাইফকে অবশ্য কৃতিত্ব দিতে হবে আরও বেশি। তাদের দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ের কারণে উইকেট মনে হয়েছে আরও বেশি ভালো। আদতে চোখধাঁধানো সব শট খেলে উইকেটের প্রতিকূলতা জয় করেছেন তারা। তাদের আগ্রাসী ব্যাটিংয়ের কারণে খেই হারিয়ে আলগা বল করেছেন ক্যারিবিয়ানরা। উইকেট বিবেচনায় অসাধারণ ব্যাটিং করলেও দুজনেরই শেষটা হয়েছে সেঞ্চুরি না পাওয়ার হতাশায়।
শুরু থেকেই শট খেলা ও প্রতিপক্ষকে চাপে ফেলার তাড়না দেখিয়েছেন দুজন, যা কাজে লেগে গেছে দারুণভাবে। শুরুটা করেন সাইফ। আগের ম্যাচের ক্যারিবিয়ান নায়ক আকিল হোসেনকে প্রথম ওভারেই দুটি চার মারেন সাইফ, বাঁহাতি এই স্পিনারের পরের ওভারে মারেন ছক্কা।
একটু সাবধানে শুরু করা সৌম্যর প্রথম চার আসে ব্যাটের কানায় লেগে। একটু পর তিনি জেগে ওঠেন রোস্টন চেইসকে রিভার্স সুইপে ছক্কা মেরে। এই অফ স্পিনারকেই পরে তিনি আরেকটি ছক্কা মারেন রিভার্স শটে, সাইফ ছক্কায় ওড়ান মাথার ওপর দিয়ে।
১০ ওভারেই ৭৪ রান তুলে ফেলে বাংলাদেশ।
সেখানেই না থেমে আরও এগিয়ে যান দুজন। ৪৫ ইনিংস পর ওয়ানডেতে শতরানের শুরুর জুটি পায় বাংলাদেশ।
দুজনই অবশ্য একটু সুযোগের মতো দিয়েছিলেন। ২৯ রানে সৌম্যর কঠিন ক্যাচ নিতে পারেননি আলিক আথানেজ, ৩৯ রানে সাইফের ক্যাচ দারুণভাবে চেষ্টা করেও নিতে পারেননি কেসি কার্টি।
দুজনের জুটি শতরান পেরিয়ে দেড়শ ছাড়িয়ে এগিয়ে যায় আরও। আগের ম্যাচে ১০ ওভারে ১৪ রান দিয়েছিলেন যিনি, সেই আলিক আথানেজের প্রথম দুই ওভারেই আসে এ দিন ১৭ রান।
শেষ পর্যন্ত ১৭৬ রানে শেষ হয় জুটি। ছয়টি করে ছক্কা ও চারে ৭২ বলে ৮০ রান করে আউট হন সাইফ।

মিরপুর শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামে যে কোনো উইকেটে বাংলাদেশের সেরা জুটি এটিই। আগের সেরা ছিল ২০১৪ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে ইমরুল কায়েস ও এনামুল হকর ১৫০।
একটু পর সেঞ্চুরি না পাওয়ার হতাশায় পুড়তে হয় সৌম্যকে। ছক্কা চেষ্টায় আউট হয়ে দুহাতে মুখ ঢেকে ফেলেন তিনি। সাতটি চার ও তিন ছক্কায় ৮৬ বলে করেন তিনি ৯১।
উইকেট যে আসলে খুব ব্যাটিং-বান্ধব নয়, তা বোঝা যায় এরপরই। পরের ব্যাটসম্যানররা আর ততটা সাবলিলভাবে রান করতে পারেননি। ২৮ রান করতে তাওহিদ হৃদয় খেলেন ৪৪ বল। ক্রিজে অস্বস্তিময় ফাঁকে তিনটি ছক্কা মারেন নাজমুল হোসেন শান্ত, জীবন পান দুই দফায়। শেষ পর্যন্ত ৫৫ বলে ৪৪ করে তিনি আউট হন নিজের বলে আথানেজের অসাধারণ এক ক্যাচে।
এরপর সময়ের দাবি মেটাতে পারেননি মাহিদুল ইসলাম অঙ্কন (১০ বলে ৬) ও রিশাদ হোসেন (৬ বলে ৩)। ডানহাতি-বাঁহাতি ভারসাম্যের জন্য নুরুল হাসান সোহানের ওপরে পাঠানো হয় নাসুম আহমেদকে। তিনিও পারেননি ভালো কিছু করতে (২ বলে ১)।
অধিনায়ক মেহেদী হাসান মিরাজ ৯ নম্বরে নেমে ১৭ বলে করেন ১৭। শেষ দিকে রান একটু বাড়ে সোহানের ব্যাটে (৮ বলে ১৬*)।
সেই রানও অবশ্য ছিল যথেষ্টরও বেশি। বাংলাদেশের স্পিনের সামনে স্রেফ মুখ থুবড়ে পড়ে ক্যারিবিয়ান ব্যাটিং। নতুন বলে নাসুম আহমেদের কোনো জবাব খুঁজে পাননি তারা। প্রথম তিনটি উইকেটই নেন এই বাঁহাতি স্পিনার। এরপর তানভির ইসলাম ও রিশাদ হোসেনের ছোবলে ভেঙে পড়ে ক্যারিবিয়ান ব্যাটিং।
শেষ দুটি উইকেট নিয়ে ম্যাচ শেষ করেন মিরাজ। নেতৃত্ব নিয়ে প্রবল সমালোচনার মুখে থাকা অলরাউন্ডার অধিনায়ক হিসেবে পেলেন প্রথম সিরিজ জয়ের স্বাদ।
দুই দল এখন লড়বে টি-টোয়েন্টি সিরিজে। চট্টগ্রামে তিন ম্যাচের সিরিজটি শুরু সোমবার।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
বাংলাদেশ: ৫০ ওভারে ২৯৬/৮ (সাইফ ৮০, সৌম্য ৯১, হৃদয় ২৮, শান্ত ৪৪, মাহিদুল ৬, রিশাদ ৩, নাসুম ১, সোহান ১৬*, মিরাজ ১৭; আকিল ১০-১-৪১-৪, চেইস ৮-১-৫৩-১, পিয়ের ১০-০-৪৬-০, গ্রেভস ৭-০-৬১-০, মোটি ৮-০-৫৩-১, আথানেজ ৭-০-৩৭-২)।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ: ৩০.১ ওভারে ১১৭ (আথানেজ ১৫, কিং ১৮, ওগিস ০, কার্টি ৩৫, হোপ ৪, রাদারফোর্ড ১২, চেইস ০, গ্রেভস ১৫, মোটি ৭, আকিল ২৭, পিয়ের ০; নাসুম ৬-১-১১-৩, মিরাজ ৭.১-০-৩৫-২, তানভির ৮-০-১৬-২, রিশাদ ৯-০-৫৪-৩)।
ফল: বাংলাদেশ ১৭৯ রানে জয়ী।
সিরিজ: তিন ম্যাচ সিরিজে বাংলাদেশ ২-১ ব্যবধানে জয়ী।
ম্যান অব দা ম্যাচ: সৌম্য সরকার।
ম্যান অব দা সিরিজ: রিশাদ হোসেন।
আপনার মতামত লিখুন :