আশ্বিনের শেষ দিন। শরতের রূপের সবটুকু ফুটে উঠছিল যেন বিকেএসপির আকাশে। নীল আকাশে পেঁজা তুলোর মতো ভেসে বেড়াচ্ছিল সাদা মেঘ। রোদে নেই ঝাঁজ, বাতাসে আরামদায়ক ছোঁয়া। শীতের আগমনী জানান দিতে সকালের দিকে ছিল বেশ কুয়াশাও। পুবের আকাশে সূর্য উঁকি দেওয়ার পর কুয়াশা মিলিয়ে গেছে, কিন্তু ঘাসের ডগায় ছিল শিশিরের ছোঁয়া। বিকেএসপির তিন নম্বর মাঠে তখন টানটান উত্তেজনা। বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ নারী দল বাছাইয়ের জন্য চলছে প্রস্তুতি ম্যাচ।
বোলার দৌড় শুরু করছেন যখন, স্টাম্পের পেছন থেকে কিপারের চিৎকার “বল ভেতরে রাখো….!” ডেলিভারির পর ভেসে আসে তালি আর বাহবার উচ্চারণ। চারপাশের নীরবতা কাটিয়ে সেই চিৎকারে ফুটে ওঠে যেন ক্রিকেটের উদযাপন।
এমনিতেই বাংলাদেশে মেয়েদের ক্রিকেট পাদপ্রদীপের কিছুটা আড়ালেই থাকে বেশির ভাগ সময়। তবে এখন চলছে উইমেন’স ওয়ানডে বিশ্বকাপ। শ্রীলঙ্কা-ভারতে নিগার সুলতানা, মারুফা আক্তার, নাহিদা আক্তার, স্বর্ণা আক্তার, ফাহিমা খাতুনদের পারফরম্যান্সে নজর রাখছেন ক্রিকেট অনুসারীদের অনেকেই। অনেকটা আড়ালেই এই সময়ে বিকেএসপিতে চলছে ভবিষ্যতের নিগারদের খোঁজার পালা।
মূলত ঘরের মাঠে ২০২৭ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের জন্য দল গঠনের প্রক্রিয়া চলছে এই ক্যাম্প থেকে। বাংলাদেশে নারী ক্রিকেটে বয়সভিত্তিক কাঠামো সেভাবে নেই এখনও। এসব ক্যাম্প, প্রস্তুতি ম্যাচ আর ঘরোয়া ক্রিকেটই ভরসা দল বাছাইয়ের জন্য।
চলতি উইমেন’স ওয়ানডে বিশ্বকাপ শেষ হওয়ার পরই শুরু হবে মেয়েদের জাতীয় ক্রিকেট লিগ। ততদিনে ছেলেদের জাতীয় লিগও শুরু হয়ে যাবে। মেয়েদের জাতীয় লিগে সিনিয়র দল খেলবে, তাদের সঙ্গে থাকবেন বিকেএসপির ক্যাম্পের ২৩–২৪ উঠতি ক্রিকেটারও।
নির্বাচক সাবেক পেসার সজল চৌধুরি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরডটকমকে জানালেনে, এই লিগের পারফরম্যান্সই নির্ধারণ করে দেবে পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজের দল। পাঁচ ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজ খেলতে আগামী ৩০ নভেম্বর বাংলাদেশে আসবে পাকিস্তান অনূর্ধ্ব-১৯ দল। সিরিজটি হবে কক্সবাজারে।
দল বাছাইয়ের প্রক্রিয়ায় বিকেএসপিতে বুধবার দেখা গেল চেনা এক মুখকে। বাংলাদেশের নারী ক্রিকেটের প্রথম তারকা সালমা খাতুন ড্রেসিংরুমের পাশে একটা সাদা চেয়ারে চুপচাপ বসে নোটবুকে কিছু লিখে যাচ্ছিলেন। সাবেক অধিনায়ক এখন প্রথম নারী নির্বাচকের ভূমিকায়। চোখের সামনে যা ঘটছে, একেকটা ডেলিভারি, থ্রো, ক্যাচ সবকিছুই তিনি নোট করছেন। দেশের নারী ক্রিকেটের বেড়ে ওঠার নিঃশব্দ প্রতীক যেমন দৃশ্যগুলি।
ঢাকার কলাহোল ছেড়ে গত ২৬ সেপ্টেম্বর বিকেএসপিতে শুরু হয় কিশোরী ক্রিকেটারদের এই ক্যাম্প। ২৭ ক্রিকেটার আছেন ক্যাম্পে, যাদেরকে বাছাই করা হয়েছে খুলনায় বিভাগীয় অনূর্ধ্ব–১৮ টুর্নামেন্ট থেকে। প্রথম সপ্তাহে ছিল ফিটনেস ট্রেনিং, পরের দুই সপ্তাহ চলেছে স্কিলের চর্চা। সকাল–বিকেল অনুশীলন, মাঝে ভিডিও সেশন, মাঠে থ্রো ডাউন, সব মিলিয়ে পেশাদার ক্রিকেটীয় আবহ। বিকেএসপির পথ থেকে মাঠে এই কিশোরীদের ঘাম, হাসি আর স্বপ্নের ভেতরেই যেন গড়ে উঠছে বাংলাদেশ মেয়েদের ক্রিকেটের নতুন আরেকটি অধ্যায়।
বুধবার সকালে বিকেএসপিতে প্রস্তুতি ম্যাচের অনেকটুকু দেখে বোঝা গেল, স্বপ্নের পথে ছুটতে নিবেদনের কমতি নেই এই মেয়েদের। কারও হাতে কাটা দাগ, কারও হাঁটুতে ব্যান্ডেজ, নানা আঘাতের চিহ্ন। কিন্তু প্রত্যেকের চোখে সেই বার্তা “আমরাও পারি।”
নির্বাচক সালমার কাজ কঠিন এখানেই। ২৭ জনের মধ্যে থেকে বাছাই করতে হবে ২৩–২৪ জনকে, যারা এবার জাতীয় লিগে বিভাগীয় দলে খেলবে। তার পাশে অনূর্ধ্ব–১৯ দলের নির্বাচক সজল আহমেদ চৌধুরী ব্যস্ত, নোটে চোখ বুলিয়ে কখনও মাঠের দিকে তাকাচ্ছেন, কখনও ক্যাচের সময় তালি দিচ্ছেন। তারা জানেন, এই মেয়েদের কেউ কেউ হয়তো কয়েক বছরের মধ্যে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে লড়বেন লাল–সবুজের জার্সিতে।
অনূর্ধ্ব–১৯ নারী দলের দায়িত্বে শুরুকে ছিলেন কোচ সরওয়ার ইমরান। দেশের অভিজ্ঞ এই কোচ পরে পেয়ে যান জাতীয় দলের দায়িত্ব। বিকেএসপির এই ক্যাম্পে তার জায়গা নিয়েছেন আরেক পরিচিত মুখ—খুলনার বিভাগীয় কোচ, জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক হাবিবুল বাশারের বড় ভাই এমদাদুল বাশার রিপন।
রিপন দায়িত্ব নিয়েই মেয়েদের দলটাকে নিজের মতো করে গড়ে তুলছেন। বুধবার বিকেএসপিতে তাঁর সঙ্গে কথা হলো, মাঠে তখন ম্যাচ চলছে, পেছনে শোনা যাচ্ছে ব্যাট-বলের শব্দ। তিনি হেসে বললেন, “আমাদের মেয়েগুলো ভীষণ পরিশ্রমী। মানসিকতা খুব ভালো, মাটির মতো নরম। এই বয়সে ওদের যেভাবে গড়া যাবে, ওরা সেভাবেই তৈরি হবে।”
এই উঠতি ক্রিকেটারদের স্বপ্নে নতুন রঙ ছড়িয়ে দিতেও চেষ্টার কমতি নেই কোচের।
“আমি ওদের ঝোঝাতে চাই—তোমরা এখন দেশের সেরা ২৭ জন কিশোরী ক্রিকেটার। মেয়েদের ক্রিকেটে তোমাদেরই তৈরি হতে হবে নতুন কেতন হয়ে। যারা আগামী দিনে জাতীয় দলের ব্যাট, বল আর সাহসের দায়িত্ব নেবে।”
কথা বলার ফাঁকেই তিনি মাঝে মাঝে মাঠের দিকে তাকান, কাউকে ডেকে কিছু বোঝান, আবার কথা বলেন। এই দলটার তিনি শুধু কোচ নন, যেন একজন কারিগরও; এই প্রজন্মের ক্রিকেটারদের ভেতরে বিশ্বাস গেঁথে দিচ্ছেন ধীরে ধীরে।
রিপন জানালেন, এই ক্যাম্পের মূল উদ্দেশ্য শুধু ঘরের মাঠে পাকিস্তানের সঙ্গে সিরিজের প্রস্তুতি নয়। দৃষ্টি তাদের ২০২৭ বিশ্বকাপে।
‘‘বিকেএসপিতে আগের কয়েকদিন বৃষ্টিতে ম্যাচ খেলতে পারিনি। বুধবার, বৃহস্পতিবার ম্যাচ খেলা হবে। আমরা জাতীয় লিগে এই মেয়েদের বেশির ভাগের খেলাই দেখব। সেখানে নতুন কোনো মেয়ে পারফর্ম করে, ওদেরকে নিয়েও আমরা ২০২৭ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ দলটায় যুক্ত করব। আর মেয়েদের আগের অনূর্ধ্ব–১৯ দল থেকে পাচঁজন আছে। নভেম্বরে শেষে পাকিস্তান আসবে। এরপর আমরা হয়তো আরও কিছু সিরিজ খেলব। এগুলো নিয়ে আলোচনা চলছে।”
“পাকিস্তান সিরিজের জন্য আমরা দল হয়তো জাতীয় লিগের পরেই দেব। এখন কয়েকজনকে নজরে রাখছি। সম্ভাব্য দুই একজনকে দেখছি যে কেমন করে।”
অনূর্ধ্ব–১৯ দলের নির্বাচক সজল আহমেদ চৌধুরী জানালেন, বিকেএসপিতে শেষের পথে থাকা ক্যাম্পটির সময় স্বল্পতা ও বৈরি আবহাওয়ার জন্য ক্রিকেটারদের ম্যাচ খেলার ঘাটতি খানিকটা রয়েছে। তবে জাতীয় লিগে এই ক্যাম্পের মেয়েদের বেশিরভাগ সুযোগ দিয়ে আমরা সেই ঘাটতি পূরণের চেষ্টা করা হবে।
‘‘এই ক্যাম্পের ২৭জন ক্রিকেটার থেকে প্রায় ২৩ জন জাতীয় লিগে (এনসিএলে) বিভিন্ন ডিভিশনের হয়ে খেলার সুযোগ পাবে। ওখানে ওদের ম্যাচ প্রস্ততিও ভালো হবে। পরে আমরা পাকিস্তান সিরিজের জন্য স্কোয়াড ঘোষণা করব। পাকিস্তান সিরিজের পর আমরা অনূর্ধ্ব–১৯ দলটার আরেকটা ক্যাম্প করব।”
“এভাবে তিন সপ্তাহ করে ক্যাম্প হবে। প্রথম সপ্তাহ ফিটনেস, পরের দুই সপ্তাহ স্কিল। এভাবেই চলবে। ওটা ধারাবাহিকভাবে চলবে, পরবর্তী ধাপ পর্যন্ত। তারপর তো প্রিমিয়ার লিগও আসবে। এই ক্যাম্পটাও আমাদের ২০ দিনের ক্যাম্প।’’
সজল জানালেন, এই দলটার শুরু থেকেই ঘনিষ্ঠভাবে নজর রাখছেন ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের নাজমূল আবেদীন ফাহিম। এখন নারী বিভাগের নতুন পরিচালক হিসেবে দায়িত্বে আছেন আব্দুর রাজ্জাক। তাদের সঙ্গেও নিয়মিত যোগাযোগ থাকে নির্বাচকদের।
“আমাদের নির্বাচক প্যানেলে সালমা আছে, জাতীয় দলের প্রধান নির্বাচক সাজ্জাদ আহমেদ ভাই আছেন, আমি আছি—তিনজন মিলে আমরা কাজ করছি। সালমা নতুন এসেছে, তাই নির্বাচনের প্রক্রিয়াটা কাছ থেকে শিখছে।”
‘‘আমি এই অনূর্ধ্ব–১৯ দলটা ছাড়াও ইমার্জিং দল নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় থাকি। সালমা যেহেতু নতুন যোগ দিয়েছে, আমাদের নির্বাচনের ধরনটা ও শিখছে। ধারণা নিচ্ছে। বিকেএসপিতে জাতীয় লিগের আট দল নিয়েই প্রস্তুতি শুরু হবে ৫ নভেম্বর থেকে। ৮ নভেম্বর থেকে বিকেএসপির ৩ ও ৪ নম্বর মাঠে ম্যাচ হবে দুটো করে। সাতদিনেই মেয়েদের জাতীয় লিগ শেষ হবে। এরপর চার-পাঁচ দিনের বিশ্রাম দেব মেয়েদের। তারপরই পাকিস্তান সিরিজ। এই সিরিজের আগে চার পাচঁদিনের ক্যাম্প করব কক্সবাজারে। ”
বাংলাদেশে মেয়েদের ক্রিকেট এখনও লড়ছে অনেক সীমাবদ্ধতাকে সঙ্গী করে। সজল আহমেদ চৌধুরি কণ্ঠে তাই খানিকটা আক্ষেপও শোনা গেল।
“আমাদের মেয়েরা দেখবেন ক্যাম্প করে একেক জায়গায়, দূরে দূরে। একটা ‘সেন্টার অব এক্সিলেন্স’ থাকলে সারা বছর ট্রেনিং চালানো যেত। বিদেশে দেখবেন, এমন সেন্টারে সারা বছরই ট্রেনিং হয়, আবার কেউ চোট পেলে সেখানেই রিহ্যাবের সুযোগ থাকে। আমাদের এমনিতেই মেয়েদের সংখ্যা কম। জাতীয় দলের বাইরে মানসম্পন্ন ২৫ জন ক্রিকেটারও হাতে নেই। তবু যা আছে, তা নিয়েই আমরা চেষ্টা করছি।”
“এবারই আমরা দুজনকে দিতে পেরেছি সিনিয়র দলে। যদি প্রতি বছর আমাদের অনূর্ধ্ব–১৯ দল থেকে ২–৩ জন করে তুলে আনতে পারি, তাহলে জাতীয় দলের পাইপলাইন শক্ত হবে। কিন্তু তার জন্য সারা বছর প্রস্তুতি দরকার ম্যাচ, সিরিজ, সফর। নতুন মেয়েদের ঘরের মাঠেই বেশি খেলতে দিতে হবে। তাহলে বাইরের সিরিজে নামার আগে তারা অন্তত প্রস্তুত থাকবে।”
বাংলাদেশ দল ওয়ানডে মর্যাদা পেয়েছে বহুদিন আগেই। বছর চারেক আগে মিলেছে টেস্ট মর্যাদাও। তবে এখনও টেস্ট অভিষেক হয়নি। তেমন কোনো উদ্যোগও চোখে পড়েনি। এখনও প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটই ঠিকঠাক করা যায়নি বলে আরও আক্ষেপ এই নির্বাচকের।
‘‘বড় দৈর্ঘ্যের ক্রিকেট খেলার মতো রসদ আমাদের হাতে খুবই সীমিত। আন্তর্জাতিক সিরিজ খেলতেও সুযোগ কম পাই। আমরা যেসব ম্যাচ খেলি, সেগুলো বেশিরভাগই লিস্ট ‘এ’। কিন্তু লিস্ট ‘এ’ আর প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের পার্থক্য বিশাল।জাতীয় দলে আমাদের ১১-১৫ জন ক্রিকেটার আছে, কিন্তু চার বা পাঁচ দিনের ম্যাচ খেলার মতো ফিটনেস সবার নেই। এই কারণেই এখনো আমাদের মেয়েদের জাতীয় লিগ টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে খেলতে হচ্ছে। যদিও প্রকৃত অর্থে এটা হওয়া উচিত ছিল তিন কিংবা চার দিনের ম্যাচ।”
তাই এখন সবচেয়ে বড় তাগিদ, কীভাবে শক্ত কাঠামোয় জাতীয় লিগে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট চালু করা যায়। তবে সময় নিয়ে, ভেবেচিন্তে এগোনোর পক্ষে সজল চৌধুরি।
আপনার মতামত লিখুন :