
উইমেন’স ওয়ানডে বিশ্বকাপ
কিছু গল্প যেন রূপকথাকেও হার মানায়। এই যেমন শেফালি ভার্মা। সপ্তাহখানেক আগেও যিনি ছিলেন না বিশ্বকাপের ধারেকাছে, খেলছিলেন ঘরোয়া ক্রিকেটে, নাটকীয় মোড়ে হঠাৎ তিনি চলে এলেন বিশ্ব মঞ্চে, ফাইনালে ব্যাটে-বলে দুর্দান্ত পারফরম্যান্সে ভারতের প্রথম শিরোপা জয়ে রাখলেন উল্লেখযোগ্য অবদান। ম্যাচ শেষে তার উচ্চারণ, ‘ঈশ্বর আমাকে ভালো কিছু করার জন্য এখানে পাঠিয়েছেন।’
নাভি মুম্বাইয়ে রোববার ফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকাকে ৫২ রানে হারিয়ে প্রথমবারের মতো উইমেন’স ওয়ানডে বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ পায় ভারত। তাদের ফাইনাল জয়ের প্রধান চরিত্রের একজন শেফালি।
গত অগাস্টে যখন বিশ্বকাপের ১৫ জনের চূড়ান্ত দল ঘোষণা করে ভারত, সেই দলে শেফালি ছিলেন না। ‘এক্স ফ্যাক্টরের’ চেয়ে ধারাবাহিকতাকে প্রাধান্য দিয়ে, স্মৃতি মান্ধানার উদ্বোধনী জুটির সঙ্গী হিসেবে নির্বাচকরা বেছে নেন প্রাতিকা রাওয়ালকে।
শেফালি জায়গা পাননি এমনকি রিজার্ভ তালিকাতেও। প্রাতিকা বিশ্বকাপে বেশ ভালো করছিলেন। কিন্তু প্রাথমিক পর্বের শেষ ম্যাচে বাংলাদেশের বিপক্ষে ফিল্ডিংয়ের সময় অ্যাঙ্কেলে চোট পেয়ে টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে পড়েন তিনি।
তার বদলি হিসেবে যখন দলে ডাক পেলেন শেফালি, তখন তিনি সিনিয়র টি-টোয়েন্টি ট্রফিতে খেলতে হরিয়ানা দলের সঙ্গে সুরাটে। সেখান থেকে নাভি মুম্বাইয়ে যোগ দেন দলের সঙ্গে।
সুযোগ পেয়ে যান সেমি-ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে একাদশে। এই ম্যাচের আগে তিনি সবশেষ ওয়ানডে খেলেছিলেন গত বছরের অক্টোবরে। ফেরার ম্যাচে ভালো করতে পারেননি, রান তাড়ায় আউট হয়ে যান ৫ বলে ১০ রান করে। শেষ পর্যন্ত যদিও সেটি বড় হয়ে ওঠেনি। জেমিমা রদ্রিগ্সের দুর্দান্ত সেঞ্চুরিতে রেকর্ড রান তাড়ায় জিতে ফাইনালে ওঠে ভারত।

ফাইনালে শেফালি উপহার দিলেন ক্যারিয়ার সেরা ইনিংস। ৩১ ম্যাচের ওয়ানডে ক্যারিয়ারে তার আগের সেরা ইনিংস ছিল অপরাজিত ৭১, ২০২২ সালের জুলাইয়ে পাল্লেকেলেতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। সবশেষ ফিফটিও ছিল সেটিই। সেটি ছাপিয়ে এবার করলেন ৭ চার ও ২ ছক্কায় ৭৮ বলে ৮৭। অল্পের জন্য প্রথম সেঞ্চুরি না পেলেও, মান্ধানার সঙ্গে তার শতরানের জুটি বড় সংগ্রহের ভিত গড়ে দেয় দলকে।
এদিন তিনি শুরুটা করেন মুখোমুখি প্রথম বলে চার মেরে। চতুর্দশ ওভারে ন্যাডাইন ডি ক্লার্ককে চোখধাঁধানো লফটেড স্ট্রেট ড্রাইভে মারেন ম্যাচের প্রথম ছক্কাও। ইনিংস জুড়েই খেলেন দারুণ সব শট।
ছেলে কিংবা মেয়েদের যে কোনো সংস্করণের বিশ্বকাপ ফাইনালে কোনো ভারতীয় ওপেনারের সর্বোচ্চ ইনিংস তার এই ৮৭।
এমনিতে শেফালির মূল পরিচয় ওপেনিং ব্যাটার হলেও, মাঝেমধ্যে অফ স্পিন বোলিংও তিনি করেন। এই ফাইনালের আগে ওয়ানডে ক্যারিয়ারে পাঁচ ইনিংসে বোলিং করে তার উইকেট ছিল একটি।
এদিন তৃতীয় উইকেটে লরা উলভার্ট ও সুনে লিসের জুটি যখন ভারতের মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠছিল, ২১তম ওভারে শেফালিকে বোলিংয়ে আনেন অধিনায়ক হারমানপ্রিত কৌর। সাফল্যও মেলে দ্রুতই, নিজের দ্বিতীয় বলে ফিরতি ক্যাচে লিসকে ফিরিয়ে ৫২ রানের জুটি ভাঙেন শেফালি। পরের ওভারে তিনি আরেকটি উইকেট নেন মারিজান ক্যাপকে ফিরিয়ে।
ম্যাচের বিবেচনায় দুটি উইকেটই খুব গুরুত্বপূর্ণ। সাত ওভারে ৩৬ রান দিয়ে উইকেট দুটি নেন শেফালি। ৩৯ রানে ৫ উইকেট নিয়ে ভারতের সফলতম বোলার যদিও দিপ্তি শার্মা। এই অফ স্পিনিং অলরাউন্ডার ব্যাটিংয়ে করেন ৩ চার ও এক ছক্কায় ৫৮ বলে ৫৮। ছেলে কিংবা মেয়েদের বিশ্বকাপের নকআউট ম্যাচে ব্যাটিংয়ে ফিফটি ও বোলিংয়ে পাঁচ উইকেট নেওয়া প্রথম ক্রিকেটার তিনি।
ফাইনাল-সেরা হওয়ার লড়াইয়ে ছিলেন তাই দুজনই। তবে দিপ্তিকে ছাপিয়ে এই স্বীকৃতি পান শেফালি। ২১ বছর ২৭৯ দিন বয়সে পুরস্কারটি পেয়ে ছেলে কিংবা মেয়েদের ওয়ানডে বিশ্বকাপ সেমি-ফাইনাল বা ফাইনালে ‘প্লেয়ার অব দা ম্যাচ’ হওয়া সর্বকনিষ্ঠ ক্রিকেটার তিনিই।
সতীর্থের চোটে এভাবে হুট করে বিশ্বকাপ সুযোগ পাওয়া, ফাইনালে দুই বিভাগেই ক্যারিয়ার সেরা পারফরম্যান্স উপহার দেওয়া, দলকে শিরোপা জিতিয়ে ‘প্লেয়ার অব দা ম্যাচ’ হওয়া, এমন কিছু হয়তো কারো কল্পনাতেও থাকে নয়।
ফাইনাল শেষে প্রাতিকার প্রতি সহমর্মিতা জানিয়ে শেফালি বললেন, সবকিছুই লিখেছেন আসলে ঈশ্বর।
“প্রাতিকার ক্ষেত্রে যা হয়েছে (চোট), একজন ক্রীড়াবিদ হিসেবে তা মোটেও ভালো কিছু নয়। কেউই চায় না, কোনো ক্রীড়াবিদ এভাবে চোট পাক। কিন্তু ঈশ্বর আমাকে ভালো কিছু করার জন্য এখানে পাঠিয়েছেন।”
তার সেই ‘ভালোটা’ ভারতকে এনে দিল স্বপ্নের ট্রফি!
                                    
                                    
                                    
                                    
                                    
                                    
                                    
                                    
                                    
                                    
                                    
                                    
                                    
                                    
                                    
                        
                        
                        
                        
                        
                        
                        
আপনার মতামত লিখুন :