
দিপ্তি শার্মার ফুল টস অফ সাইডে ঠিকমতো খেলতে পারলেন না ন্যাডাইন ডি ক্লার্ক। এক্সট্রা কাভারে ক্যাচ মুঠোয় জমিয়ে ছুটলেন ভারত অধিনায়ক হারমানপ্রিত কৌর। দলের অন্য ক্রিকেটাররাও ছুটলেন দিগ্বিদিক। ডাগআউট থেকে মাঠে ছুটে এলেন অন্যরাও। চলতে থাকল উৎসব। বহুল প্রতীক্ষার পর অবশেষে এলো কাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত, প্রথমবার উইমেন’স বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন ভারত।
রান তাড়ায় দক্ষিণ আফ্রিকা অধিনায়ক লরা উলভার্টের দুর্দান্ত সেঞ্চুরি কাজে এলো না। নাভি মুম্বাইয়ে দর্শকে ঠাসা রোববারের ফাইনালে ৫২ রানের জয়ে উইমেন’স ওয়ানডের নতুন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হলো ভারত।
২৯৯ রানের লক্ষ্য তাড়ায় দক্ষিণ আফ্রিকা গুটিয়ে যায় ২৪৬ রানে।
আগে দুটি ফাইনালে হারা ভারত তৃতীয়বারের চেষ্টায় পেল ট্রফির ছোঁয়া। প্রথমবার ফাইনালে উঠে স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় পুড়ল দক্ষিণ আফ্রিকা।

গত দুই বছরে পরপর দুটি উইমেন’স টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ফাইনালেও হেরেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। গত বছর পুরুষদের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ফাইনালেও দক্ষিণ আফ্রিকা হেরেছিল ভারতের বিপক্ষে।
সপ্তাহখানেক আগেও বিশ্বকাপের ধারেকাছে ছিলেন না যিনি, সেই শেফালি ভার্মা দুর্দান্ত অলরাউন্ড পারফরম্যান্সে ভারতের ফাইনাল জয়ের নায়ক।
মূল স্কোয়াডে তো নয়ই, রিজার্ভ তালিকাতেও ছিল না তার নাম। প্রাতিকা রাওয়াল চোট পেয়ে ছিটকে গেলে বদলি হিসেবে সেমি-ফাইনালের আগে দলে ডাক পান শেফালি। ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলতে তখন তিনি ছিলেন সুরাটে। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সেমি-ফাইনালে ভালো করতে না পারলেও, ফাইনালে ব্যাটে-বলে ক্যারিয়ার সেরা পারফরম্যান্স উপহার দিয়ে দলকে বিশ্ব জয়ের স্বাদ দিলেন তিনি।
ব্যাটিংয়ে ৭ চার ও ২ ছক্কায় ৭৮ বলে ৮৭ রান করেন শেফালি। ছেলে কিংবা মেয়েদের যে কোনো সংস্করণের বিশ্বকাপ ফাইনালে কোনো ভারতীয় ওপেনারের সর্বোচ্চ ইনিংস এটি।

পরে অফ স্পিনে নেন গুরুত্বপূর্ণ দুটি উইকেট। ওয়ানডে ক্যারিয়ারে আগে পাঁচ ইনিংসে বোলিং করে তার উইকেট ছিল একটি। এবার এক ম্যাচেই নিলেন দুটি। ফাইনাল-সেরার পুরস্কার ওঠে তার হাতেই।
অবদান কোনো অংশে কম নয় দিপ্তিরও। ব্যাটিংয়ে ৩ চার ও এক ছক্কায় ৫৮ বলে ৫৮ রানের ইনিংস খেলেন তিনি। এই অফ স্পিনিং অলরাউন্ডার বোলিংয়ে ৩৯ রানে নেন ৫ উইকেট।
ছেলে কিংবা মেয়েদের বিশ্বকাপের নকআউট ম্যাচে ব্যাটিংয়ে ফিফটি ও বোলিংয়ে পাঁচ উইকেট নেওয়া প্রথম ক্রিকেটার তিনিই।
মুম্বাইয়ের ড. ডিওয়াই পাতিল স্পোর্টস একাডেমিতে রান তাড়ায় দক্ষিণ আফ্রিকার শুরুটা হয় আশা জাগানিয়া, প্রথম ৯ ওভারে করে বিনা উইকেটে ৫১ রান। পরের ওভারে আমানজোত কৌরের সরাসরি থ্রোয়ে তাজমিন ব্রিটসের রান আউটে ভাঙে উদ্বোধনী জুটি।
দুয়ার উন্মুক্ত হওয়ার পর প্রথমবার আক্রমণে এসে আনেকা বশকে শূন্য রানে ফেরান বাঁহাতি স্পিনার শ্রি চারানি। দ্রুত দুই উইকেট হারানোর পর সুনে লিসের সঙ্গে পঞ্চাশোর্ধ জুটিতে দলকে এগিয়ে নেন উলভার্ট। দক্ষিণ আফ্রিকা অধিনায়ক পঞ্চাশে পা রাখেন ৪৫ বলে।

২১তম ওভারে শেফালিকে বোলিংয়ে আনেন অধিনায়ক হারমানপ্রিত। দ্বিতীয় বলে ফিরতি ক্যাচে লিসকে (৩১ বলে ২৫) ফিরিয়ে ৫২ রানের জুটি ভাঙেন শেফালি। সেই পথে ধরে নিজের পরের ওভারে মারিজান ক্যাপকেও বিদায় করেন তিনি।
দিপ্তি যখন ফিরিয়ে দিলেন সিনালো জ্যাফটাকে, ৩০তম ওভারে ১৪৮ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে বিপদে দক্ষিণ আফ্রিকা।
উলভার্ট এক প্রান্তে চালিয়ে যান লড়াই। তাকে দারুণ সঙ্গ দেন অ্যানেরি ডার্কসেন। দুজনের জুটিতে দুইশ পেরিয়ে যায় দক্ষিণ আফ্রিকা। ম্যাচেও ফেরে উত্তেজনা। দারুণ এক ইয়র্কারে ডার্কসেনকে (৩৭ বলে ৩৫) বোল্ড করে ৬১ রানের জুটি ভাঙেন দিপ্তি।
ওই ওভারেই উলভার্ট সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন ৯৬ বলে। ছেলে কিংবা মেয়েদের কোনো বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনাল ও ফাইনালে সেঞ্চুরি করা দ্বিতীয় ক্রিকেটার তিনি।
সেঞ্চুরির পর আর টেকেননি উলভার্ট (৯৮ বলে ১০১)। তাকেও ফেরান দিপ্তি। ডিপ মিডউইকেট থেকে বাঁ দিকে দৌড়ে তিনবারের চেষ্টায় ক্যাচ নেন আমানজোত।
একই ওভারে দিপ্তি উইকেট নেন আরেকটি, দক্ষিণ আফ্রিকার আশাও কার্যত শেষ হয়ে যায় সেখানে।
৪৫তম ওভারে চারানির এলোমেলো বোলিংয়ে কিছুটা উত্তেজনা যদিও ফেরে, তবে ওই ওভারে আয়াবোঙ্গা খাকার রান আউট ও পরের ওভারে ডি ক্লার্কের বিদায়ে ম্যাচের সমাপ্তি এবং ভারতের উল্লাস।
বৃষ্টির কারণে ম্যাচ শুরু হয় এদিন দুই ঘন্টা দেরিতে। পিচ কাভারে ঢাকা ছিল তিন ঘণ্টার বেশি সময় ধরে। তবে এর প্রভাব খুব একটা পড়েনি ভারত ব্যাটিংয়ে নামার পর। স্মৃতি মান্ধানা ও শেফালির ব্যাটে দারুণ শুরু পায় স্বাগতিকরা।
মুখোমুখি প্রথম বলে চার মেরে শুরু করেন শেফালি। বাউন্ডারি আসতে থাকে দুই ব্যাটারের ব্যাট থেকেই। প্রথম ১০ ওভারে ভারত করে ৬৪।
চতুর্দশ ওভারে ডি ক্লার্ককে চোখধাঁধানো লফটেড স্ট্রেট ড্রাইভে ম্যাচের প্রথম ছক্কা মারেন শেফালি। ফিফটির কাছে গিয়ে বাঁহাতি স্পিনার ক্লোয়ি ট্রায়নের বলে মান্ধানা (৫৮ বলে ৪৫) ক্যাচ দিয়ে ফিরলে ভাঙে ১০৪ রানের উদ্বোধনী জুটি।
ওই ওভারেই শেফালি ফিফটি পূর্ণ করেন ৪৯ বলে। ২০২২ সালের জুলাইয়ের পর প্রথমবার পঞ্চাশ ছুঁতে পারলেন তিনি।
আউট হতে পারতেন তিনি ৫৬ রানে, কিন্তু ডিপ মিডউইকেটে সহজ ক্যাচ হাতছাড়া করেন বশ।
জীবন পেয়ে এগিয়ে যান তিনি, জাগান সেঞ্চুরির সম্ভাবনা, কিন্তু মাইলফলক থেকে ১৩ রান দূরে থাকতে খাকার বলে মিড-অফে ক্যাচ দিয়ে বিদায় নেন ২১ বছর বয়সী ব্যাটার।
সেমি-ফাইনালের দুই নায়ক জেমিমা রদ্রিগ্স (৩৭ বলে ২৪) ও হারমানপ্রিত (২৯ বলে ২০) এবার থিতু হয়েও ইনিংস টেনে নিতে পারেননি। এক ধাপ ওপরে ব্যাটিংয়ের সুযোগ পেয়ে টিকতে পারেননি আমানজোত (১৪ বলে ১২)।
৪৪তম ওভারে ভারতের রান তখন ৫ উইকেটে ২৪৫। সেখান থেকে রানের গতি বাড়ে মূলত রিচা ঘোষ উইকেটে যাওয়ার পর। দ্বিতীয় বলে ছক্কা মেরে শুরু করেন তিনি। ষষ্ঠ উইকেটে রিচা ও দিপ্তির ৩৫ বলে ৪৭ রানের জুটিতে তিনশর কাছে যায় ভারত।
দিপ্তি ফিফটি করেন ৫৩ বলে। ৪৯তম ওভারে আউট হয়ে যান রিচা। ৩ চার ও ২ ছক্কায় ২৪ বলে ৩৪ রান করেন তিনি।
শেষ দুই ওভারে ভারত ১২ রানের বেশি নিতে পারেনি। তবে শেষ পর্যন্ত ম্যাচ জিতল তারা বড় ব্যবধানেই, উঁচিয়ে ধরল স্বপ্নের ট্রফি।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
ভারত: ৫০ ওভারে ২৯৮/৭ (মান্ধানা ৪৫, শেফালি ৮৭, জেমিমা ২৪, হারমানপ্রিত ২০, দিপ্তি ৫৮, আমানজোত ১২, রিচা ৩৪, রাধা ৩* ক্যাপ ১০-১-৫৯-০, খাকা ৯-০-৫৮-৩, এমলাবা ১০-০-৪৭-১, ডি ক্লার্ক ৯-০-৫২-১, লিস ৫-০-৩৪-০, ট্রায়ন ৭-০-৪৬-১)
দক্ষিণ আফ্রিকা: ৪৫.৩ ওভারে ২৪৬ (উলভার্ট ১০১, ব্রিটস ২৩, বশ ০, লিস ২৫, ক্যাপ ৪, সিনালো ১৬, ডার্কসেন ৩৫, ট্রায়ন ৯, ডি ক্লার্ক ১৮, খাকা ১, এমলাবা ০*; রেনুকা ৮-০-২৮-০, ক্রান্তি ৩-০-১৬-০, আমানজোত ৪-০-৩৪-০, দিপ্তি ৯.৩-০-৩৯-৫, চারানি ৯-০-৪৮-১, রাধা ৫-০-৪৫-০, শেফালি ৭-০-৩৬-২)
ফল: ভারত ৫২ রানে জিতে চ্যাম্পিয়ন
প্লেয়ার অব দা ম্যাচ: শেফালি ভার্মা
প্লেয়ার অব দা টুর্নামেন্ট: দিপ্তি শার্মা
                                    
                                    
                                    
                                    
                                    
                                    
                                    
                                    
                                    
                                    
                                    
                                    
                                    
                                    
                                    
                        
                        
                        
                        
                        
                        
                        
আপনার মতামত লিখুন :