
ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজ শুরুর আগে সংবাদ সম্মেলনে লিটন দাস বলেছিলেন, তাদের লক্ষ্য শুধু সিরিজ জেতাই নয়। বিশ্বকাপের আগে ব্যাটিং–বোলিংয়ে কিছু নির্দিষ্ট চ্যালেঞ্জে নিজেদের পরখ করে নিতে চেয়েছিলেন বাংলাদেশ অধিনায়ক। সেই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন বুঝে ওঠার আগেই সিরিজ হাতছাড়া। বাংলাদেশের ব্যাটিং লাইনআপকে মনে হচ্ছে ছন্নছাড়া।
টপ অর্ডারের অবস্থা তবু মন্দের ভালো। কিন্তু মিডল অর্ডার ও লোয়ার মিডল অর্ডারের অবস্থা বুঝে ওঠাই কঠিন। কারণ কিছুতেই তো কিছু হচ্ছে না! বিশেষ করে, মিডল অর্ডার বলে কিছু আছে বলে মনে হয় না প্রায়ই। এখানেই বারবার খেই হারাচ্ছে দল।
এমনিতে এই বছর টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের ফলাফল এদেশের বাস্তবতায় খারাপ নয়। ২৬ ম্যাচের ১৩টি জিতেছে দল, হেরেছে ১২টি। পরিত্যক্ত হয়েছে বাকিটি। টানা চারটি সিরিজ জয়ও ধরা দিয়েছে। বড় টুর্নামেন্ট বা এশিয়া কাপে মেলেনি প্রত্যাশিত সাফল্য। ব্যাটিংয়ে ছক্কার হার বাড়াসহ অনেক সূচকে উন্নতির ছাপ থাকলেও মিডল অর্ডারের দুর্বলতা দলকে ভোগাচ্ছে ম্যাচের পর ম্যাচ।
জাতীয় দলের প্রধান নির্বাচক গাজী আশরাফ হোসেন মাঠে বসে দেখেছেন বাংলাদেশের ম্যাচ। তার চোখে পড়েছে ব্যাটসম্যানদের ধৈর্য হারানোর প্রবণতা। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে কথোপকথনে তিনি হতাশা লুকালেন না।
‘‘টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে আমাদের হাতে খুব বেশি ম্যাচ নেই। সামনের খুব বেশি ম্যাচে বড় কোনো পরিবর্তন দেখার সুযোগও নেই। এত ম্যাচ খেলেও যদি দায়িত্ববোধ আর নিজের শক্তির জায়গা কেউ পড়তে না পারে, সেটা সত্যিই হতাশার। ব্যাটিংয়ে গিয়ে আমরা পরিস্থিতি না বুঝেই তাড়াহুড়া শুরু করি। আমাদের ব্যাটারদের উচিত ছিল উইকেটে গিয়ে ভাবা যে, আমি কোন বলটা কিভাবে খেলব, রান না হলে কোথায় ভুল হচ্ছে। এগুলো নিজেকে প্রশ্ন করলে উত্তর চলে আসে।”
“প্রয়োজনে ভিডিও অ্যানালিস্টের কাছে যেতে হবে, দেখে বুঝতে হবে, আমি কী করছি এবং কী করা উচিত ছিল। টানা ডট বল খেলতে থাকলে জুটির ব্যাটারকেও কাউন্সেলিং করতে হবে কখনও কখনও। শটস নাও হতে পারে, কিন্তু স্ট্রাইক রোটেশন হলে চাপ কমে যায় অনেক সময়। জুটিতে একজন সেট ব্যাটার থাকলে অপরজনের ডট বলগুলো পুষিয়ে দিয়েও মাঝে মধ্যে রান তোলা যায়।”
প্রয়োজনের সময় জুটি গড়তে না পারা নিয়েও আক্ষেপ করলেন প্রধান নির্বাচক।

‘‘উইকেটে ২০ রানের জায়গায় যদি ৪০ রানের জুটি হয়, সেটা পিছিয়ে থাকা ম্যাচও ফিরিয়ে এনে দিতে পারে। প্রতিপক্ষ তখন ভালো বোলারদের আক্রমণে নিয়ে আসে জুটি ভাঙতে। পরে তুলনামূলক সহজ বোলারদের মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। দুই ম্যাচেই আমাদের শুরুর ব্যাটাররা নিজেদের জুটি ধরে রেখে স্ট্রাইক রোটেশন করে নির্দিষ্ট ওভারগুলোতে ‘টার্গেট হিটিং’ করার চেষ্টা করতে পারতেন।’’
মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যানরা ভালো করতে পারছেন না, এর চেয়েও বড় ব্যাপার, তাদেরকে ভালো করার আবহ দিতে পারছে না দল। মিডল অর্ডারে কে কবে কোথায় ব্যাট করবেন, অনুমান করাও কঠিন। সেই ব্যাটসম্যানদের কাছে সঠিক বার্তা কতটা দিতে পারছে টিম ম্যানেজমেন্ট, তাদের ভূমিকা কতটা পরিস্কার করে বোঝাতে পারছে, সেই প্রশ্নও উঠছে।
সেই সংশয়ের ছবি ফুটে ওঠে পরিসংখ্যানেও। মিডল অর্ডারে কেবল তাওহিদ হৃদয় মোটামুটি নিয়মিত একটি পজিশনে ব্যাট করতে পেরেছেন। এ বছর ২০ ইনিংসের ১৭টিতে চার নম্বরে খেলেছেন তিনি। দুই ইনিংস খেলেছেন তিনে, একটি পাঁচে।
কিন্তু অন্যরা এত ভরসা পাননি কোনো পজিশনে। জাকের আলি ২১ ইনিংসের মধ্যে চার নম্বরে ব্যাট করেছেন তিন ইনিংসে, পাঁচ ও ছয়ে খেলেছেন আট ইনিংস করে, সাতে দুই ইনিংস।
সাইফ হাসানকে দলে নেওয়া হয়েছিল মূলত চার নম্বর বা মিডল অর্ডারের অন্য পজিশনের ভাবনায়। অথচ এখন তিনি হয়ে গেছেন মূল ওপেনার। চারে খেলেছেন কেবল একটি ইনিংস। ওপেন করেছেন সাত ইনিংসে, তিন ইনিংসে খেলেছেন তিনে।
দলের মূল ফিনিশার ভাবা হয় যাকে, সেই শামীম হোসেন নানা সময়ে ব্যাট করেছেন চার থেকে সাত পর্যন্ত চারটি পজিশনেই। নুরুল হাসান সোহান সাত ইনিংসে ব্যাট করেছেন ভিন্ন তিনটি পজিশনে।
টি-টোয়েন্টিতে এমনিতে কখনও কখনও ব্যাটিং অর্ডার ঠিক রাখা কঠিন হয়ে পড়ে বটে। ম্যাচের পরিস্থিতি বুঝে তাৎক্ষনিক অনেক সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তবে সাধারণ হিসেবে সুনির্দিষ্ট জায়গা থাকে সবারই। সেই আদর্শ চিত্র অনুপস্থিত বাংলাদেশের মিডল অর্ডারে। ব্যাটারদের জায়গা ঘনঘন পরিবর্তন হলে তার আত্মবিশ্বাসে যেমন টান পড়ে, তেমনি ভূমিকা নিয়ে সংশয় দেখা দেয়, বাধাগ্রস্ত হয় ধারাবাহিকতা।
স্থিরতার ঘাটতি, বিচ্ছিন্ন পরিকল্পনা আর সামগ্রিক সমন্বয়হীনতার ফল মাঠে দৃশ্যমান। চাপের মুহূর্তে ভুল সিদ্ধান্ত, ম্যাচ ফিনিশিংয়ে দুর্বলতা, সঠিক সময়ে বড় ইনিংসের অভাব, সবই ফুটে উঠেছে নানা সময়ে।
এমন পরিস্থিতিতে প্রধান নির্বাচক বড় ফারাক দেখছেন নিজের ভাবনার সঙ্গে ক্রিকেটারদের চিন্তাভাবনা আর মাঠের বাস্তবের মধ্যে । তার ধারণা, পরিকল্পনা থাকা সত্ত্বেও বাস্তবায়নে সেই ছাপ মিলছে না, আর সেখানেই ম্যাচে পার্থক্য তৈরি হচ্ছে।
‘‘আমার চিন্তার সঙ্গে ওদের খেলার ধরন মিলছে না। অনেক সময় যদি ওভারপ্রতি ৮ রান করে তুলতে না পারি, তখন আমাদের তো স্ট্রাইক রোটেট করে রানের প্রবাহ চালু রাখতে হবে। কয়েক ওভার পরে পরিস্থিতি বদলে যেতে পারে। আমাকে তখনই টার্গেট করে খেলতে হবে।”
“হাতের রেখা দেখার জন্য আতশী কাঁচ দিয়ে দেখতে হয় নিজের ভাগ্য। ঠিক তেমনি মাঠের ক্রিকেটেও বড় শট খেলার জন্য বিকল্প ভাবনাগুলোকে সজাগ রাখতে হয়। গায়ের জোর সবসময় কাজে আসে না। বল খেলতে যেমন ভালো ব্যাট সুইং দরকার, তেমনি বল ব্যাটের মাঝে লাগানোটাও গুরুত্বপূর্ণ। এসবে উন্নতি করতে পারলে সমস্যাগুলো কাটিয়ে ওঠা যাবে।’’
প্রত্যাশা পূরণ করতে না পারা সবাইকে ছুড়ে ফেলাও উপযুক্ত সমাধান মনে করেন না প্রধান নির্বাচক।
‘‘এখন যারা রান পাচ্ছে না, তাদের ছেঁটে ফেলাও সম্ভব নয়। তাদের পেছনে সময় ব্যয় হয়েছে। তাদের জন্য হয়তো আরও কিছুটা সময় থাকবে। তাদের কাউকে কাউকে ইর্মাজিং এশিয়া কাপ খেলতে পাঠাব, যেটা কাতারে হবে। সেখানে নিজেদের ছন্দ পাওয়ার সুযোগ থাকবে। বিপিএল ম্যাচ থাকবে, সেখানে ম্যাচে ভালো করলে সুযোগ থাকবে।”
“সুযোগ হয়তো থাকবে একাধিক, কিন্তু নিজেদেরই বের হয়ে আসতে হবে সমস্যা থেকে। কোচরা হয়তো অনুশীলনে প্রক্রিয়াটা নিয়ে আলোচনা বা দেখানোর কাজটা করতে পারেন। কিন্তু আসল কাজটাই ক্রিকেটারের হাতে।’’
 
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                        
আপনার মতামত লিখুন :