
উইমেন’স ওয়ানডে বিশ্বকাপ
ন্যাডাইন ডি ক্লার্কের স্লোয়ার ডেলিভারিতে মিড অফে ধরা পড়লেন ইংল্যান্ডের শেষ ব্যাটার লিন্সে স্মিথ। গর্জন করে উঠলেন দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটাররা। সবাই এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলেন বোলারকে। চলতে থাকল একে অন্যকে আলিঙ্গন, উল্লাস। ক্রাইস্টচার্চ আর ব্রিস্টলে হৃদয় ভাঙার পর অবশেষে কাঙ্ক্ষিত সেই মুহূর্ত এলো গুয়াহাটিতে, প্রথমবার উইমেন’স ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকা!
প্রথম সেমি-ফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকার জয় ১২৫ রানে। গুয়াহাটিতে বুধবার ৩১৯ রানের বড় পুঁজি গড়ে চারবার শিরোপা জয়ী ইংল্যান্ডকে ১৯৪ রানে গুটিয়ে দিয়েছে লরা উলভার্টের দল।
গত দুই আসরে এই ইংল্যান্ডের বিপক্ষেই সেমি-ফাইনালে হেরে বিদায় নিতে হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকাকে। এবারের আসরে প্রথম পর্বে ইংলিশদের বিপক্ষে ৬৯ রানে গুটিয়ে ম্যাচ হেরেছিল তারা ১০ উইকেটে। সেই দলকেই এবার ব্যাটে-বলে গুঁড়িয়ে, মধুর প্রতিশোধ নিয়ে শিরোপার মঞ্চে পা রাখল দক্ষিণ আফ্রিকা।
২০ চার ও ৪ ছক্কায় ১৪৩ বলে ১৬৯ রানের দুর্দান্ত ইনিংস খেলে এই জয়ের মূল কারিগর অধিনায়ক উলভার্ট। ম্যাচ-সেরার পুরস্কার উঠেছে তার হাতেই।
২৬ বছর বয়সী উলভার্টের ইনিংসটি ঝড় তুলেছে রেকর্ড বইয়েও। উইমেন’স ওয়ানডে বিশ্বকাপের নকআউট ম্যাচে কোনো অধিনায়কের প্রথম সেঞ্চুরি, বিশ্বকাপে কোনো অধিনায়কের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ইনিংস, দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে সর্বোচ্চ ইনিংস- দারুণ সব অর্জন ধরা দিয়েছে তার ব্যাটে।

বড় অবদান রাখেন মারিজান ক্যাপও। সাত ওভারে তিন মেডেনে স্রেফ ২০ রানে ৫ উইকেট শিকার করেন ৩৫ বছর বয়সী পেস বোলিং অলরাউন্ডার। ব্যাট হাতে তিনি করেন ৩৩ বলে ৪২ রান।
এই সংস্করণে দুইবার পাঁচ উইকেটের স্বাদ পেলেন ক্যাপ, দুবারই বিশ্বকাপে এবং ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। ২০২২ আসরে মাউন্ট মঙ্গানুইয়ে ৫ উইকেট নিয়েছিলেন ৪৫ রানে।
তার আগে বিশ্বকাপে একাধিকবার পাঁচ উইকেট নিতে পেরেছেন কেবল দুজন- অস্ট্রেলিয়ার লিন ফুলস্টন ও ইংল্যান্ডের আনিয়া শ্রুবসোল, প্রত্যেকেরই দুইবার করে।
ভারতের ঝুলান গোস্বামিকে (৪৩) ছাড়িয়ে উইমেন’স ওয়ানডে বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি উইকেটের রেকর্ডও গড়েছেন ক্যাপ (৪৪)।
ইনিংসের প্রথম ওভারে কোনো রান না দিয়েই অ্যামি জোন্স ও হিদার নাইটের উইকেট নেন তিনি। দ্বিতীয় ওভারে একটি ওয়াইডের পর বৈধ প্রথম বলে ট্যামি বাউমন্টকে ফেরান আয়াবোঙ্গা খাকা।
প্রথমবারের মতো কোনো ওয়ানডে ইনিংসে শূন্য রানে ফিরলেন ইংল্যান্ডের টপ অর্ডারের তিন ব্যাটার। আর এই সংস্করণে কোনো দলের ১ রানে প্রথম তিন উইকেট হারানোর তৃতীয় নজির এটি।
দুঃস্বপ্নের শুরুর পর চতুর্থ উইকেটে প্রতিরোধ গড়েন অধিনায়ক ন্যাট সিভার-ব্রান্ট ও অ্যালিস ক্যাপসি। ১০৭ রানের জুটি গড়েন দুজন। এই জুটি ভাঙার পর আর পেরে ওঠেনি তারা, ত্রিশ ছাড়াতে পারেনি আর কোনো জুটি।
ফিফটির পরপরই বিদায় নেন ক্যাপসি (৭১ বলে ৫০)। ক্যাপ বিদায় করেন সিভার-ব্রান্টকে (৭৬ বলে ৬৪)। নিজের পরের ওভারে পরপর দুই বলে আরও দুটি শিকার ধরে পাঁচ উইকেট পূর্ণ করেন তিনি।
স্মিথের ৩৬ বলে ২৭ রানের ইনিংসে কোনোমতে বিশ্বকাপে নিজেদের সবচেয়ে বড় হার এড়াতে পারে ইংল্যান্ড। ১৯৯৮ আসরে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ১২৬ রানে হেরেছিল তারা।
শেষের মতো দক্ষিণ আফ্রিকার ম্যাচের শুরুটাও ছিল দারুণ। টস হেরে ব্যাটিংয়ে নেমে ম্যাচের প্রথম দুই বলে চার মেরে শুরু করেন উলভার্ট। তার ব্যাটে বাউন্ডারি আসতে থাকে নিয়মিত। তাকে সঙ্গ দিয়ে যান তাজমিন ব্রিটস। পাওয়ার প্লেতে দক্ষিণ আফ্রিকা করে বিনা উইকেটে ৫৮ রান।
পঞ্চদশ ওভারে সোফি এক্লেস্টোনকে চার মেরে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম ও বিশ্বের ষষ্ঠ ব্যাটার হিসেবে উইমেন’স ওয়ানডেতে পাঁচ হাজার রানের মাইলফলক স্পর্শ করেন উলভার্ট। পঞ্চাশ স্পর্শ করেন তিনি ৫২ বলে।

ফিফটি থেকে ৫ রান দূরে থাকতে ব্রিটসের বিদায়ে ভাঙে ১১৬ রানের শুরুর জুটি। ৬ চার ও এক ছক্কায় গড়া ব্রিটসের ৬৫ বলে ৪৫ রানের ইনিংস। এক্লেস্টোনের ওই ওভারেই শূন্য রানে ফেরেন আনেকা বশ।
টিকতে পারেননি সুনে লিসও। দ্রুত তিন উইকেট হারানোর পর চতুর্থ উইকেটে ৬৬ বলে ৭২ রানের জুটিতে দলকে এগিয়ে নেন উলভার্ট ও ক্যাপ। এরপর আবার দ্রুত তিন ব্যাটারকে হারানোর ধাক্কা।
১১৫ বলে দশম ওয়ানডে সেঞ্চুরি করে এগিয়ে যান উলভার্ট। সপ্তম উইকেটে ক্লোয়ি ট্রায়নের সঙ্গে ৪৭ বলে ৮৯ রানের বিস্ফোরক জুটিতে দলের স্কোর তিনশর কাছে নিয়ে ৪৮তম ওভারে থামেন অধিনায়ক। ২৬ বলে ৩৩ রানে অপরাজিত রয়ে যান ট্রায়ন।
শেষ ১০ ওভারে ২ উইকেট হারিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা তোলে ১১৭ রান। তাতে যে উচ্চতায় উঠল তাদের স্কোর, তার ধারেকাছেও যেতে পারল না ইংল্যান্ড।
প্রথম শিরোপার লক্ষ্যে দ্বিতীয় সেমি-ফাইনালে ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার জয়ী দলের মুখোমুখি হবে দক্ষিণ আফ্রিকা।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
দক্ষিণ আফ্রিকা: ৫০ ওভারে ৩১৯/৭ (উলভার্ট ১৬৯, ব্রিটস ৪৫, বশ ০, লিস ১, ক্যাপ ৪২, সিনালো ১, ডার্কসেন ৪, ট্রায়ন ৩৩, ডি ক্লার্ক ১১; বেল ১০-০-৫৫-২, স্মিথ ১০-০-৬৯-০, সিভার-ব্রান্ট ৮-০-৬৭-১, ডিন ১০-০-৬৭-০, এক্লেস্টোন ১০-১-৪৪-৪, ক্যাপসি ২-০-১৫-০)
ইংল্যান্ড: ৪২.৩ ওভারে ১৯৪ (জোন্স ০, বাউমন্ট ০, নাইট ০, সিভার-ব্রান্ট ৬৪, ক্যাপসি ৫০, ওয়াট-হজ ৩৪, ডাঙ্কলি ২, ডিন ০, এক্লেস্টোন ২, স্মিথ ২৭, বেল ৯*; ক্যাপ ৭-৩-২০-৫, খাকা ৮-০-২৮-১, ডি ক্লার্ক ৫.৩-০-২৪-২, এমলাবা ৮-০-৪০-১, লিস ৬-০-৪১-১, ট্রায়ন ৮-০-৪১-০)
ফল: দক্ষিণ আফ্রিকা ১২৫ রানে জয়ী
প্লেয়ার অব দা ম্যাচ: লরা উলভার্ট
আপনার মতামত লিখুন :