শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামের মূল মাঠ থেকে বেরিয়ে হনহন করে একাডেমি মাঠের দিকে হেঁটে যাচ্ছিলেন টনি হেমিং। তার দিকে ছুটে গিয়ে উইকেট নিয়ে কথা বলতে চাইতেই আন্তরিকভাবে অনেক কিছু বললেন বিসিবির টার্ফ ম্যানেজমেন্টের প্রধান। কথার এক পর্যায়ে বিখ্যাত এই অস্ট্রেলিয়ান কিউরেটর বললেন, “আমি কোনো জাদুকর নই। তবে চেষ্টা করেছি, আশা করি ভালো কিছুই হবে…।”
ভালোর চেয়ে বেশি আলোচনা এখন অবশ্য ‘কালো’ নিয়ে। মিরপুরের উইকেটের রঙ কেন এতটা কালো?
ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে বাংলাদেশের সিরিজ শুরুর আগের দিন সংবাদ সম্মেলনে উইকেটের প্রশ্নে বাংলাদেশ কোচ ফিল সিমন্স হেসে বললেন, ‘মিরপুরের উইকেট নিয়ে আপনারাই বেশি জানেন আমার চেয়ে।” ওয়েস্ট ইন্ডিজের কোচ ড্যারেন স্যামি তো উইকেট দেখে বিস্ময়ের চূড়ায় পৌঁছে গেলেন, “এমন কিছু জীবনেও দেখিনি…।”
এমন কিছু মানে আসলে কেমন?
এমনিতে এই স্টেডিয়ামের উইকেট বেশির ভাগ সময়ই ছিল কমবেশি কালো চেহারার। কখনও গাঢ় কালো, কখনও কালচে। তবে এবারের মতো এতটা কালো সবশেষ কবে ছিল, গবেষণার বিষয় হতে পারে।
মিরপুরে যে কোনো সিরিজ-টুর্নামেন্টের আগে বরাবরই আলোচনার কেন্দ্রে থাকে উইকেট। বছরের পর বছর এই মাঠে খেলা বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের অনেকে নানা সময়েই বলেছেন, এত ম্যাচ খেলার পরও উইকেটের চরিত্র বুঝতে তারা ধাঁধায় পড়ে যান প্রায়ই। এবার উইকেটের এমন চেহারা দেখেই হয়তো সবাই আরও বেশি কৌতূহলী। দুই দলের ক্রিকেটারদেরই দেখা গেল, অনুশীলনের ফাঁকে সুযোগ পেলেই বারবার চলে যাচ্ছেন মাঝমাঠে। ঢু মারছেন ২২ গজে।
বাংলাদেশের অনুশীলনের সময় শুক্রবার সকালে অধিনায়ক মেহেদী হাসান মিরাজকে দেখা গেল, নিচু হয়ে চটের কাভার সরিয়ে উইকেট ছুঁয়ে দেখছেন, নানাভাবে পরখ করার চেষ্টা করছেন। দুপুরে এলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ কোচ স্যামি। কিউরেটরের সঙ্গে কথা বললেন তিনি, উইকেটের মাটি পরীক্ষা করলেন সময় নিয়ে। পরে হাঁটা দিলেন ড্রেসিং রুমের দিকে।
মিরপুরে এমন দৃশ্য নতুন নয়, তবে এবার সবার চোখে একটু বাড়তি কৌতূহল। গত সপ্তাহ থেকে এই সিরিজের জন্য আলাদা করে প্রস্তুত করা হয়েছে উইকেট। তার আগে মাঠের আউটফিল্ডেও হয়েছে উন্নয়নকাজ। টেস্ট, ওয়ানডে, টি–টোয়েন্টি—সব সংস্করণ মিলিয়ে এই মাঠে খেলা হয়েছে দুই শতাধিক ম্যাচ। স্বীকৃত ম্যাচ ধরলে সংখ্যা হাজার ছুঁইছুঁই। তবু এই উইকেট নিয়ে রহস্যের শেষ নেই।
এবার উইকেট ঘনকালো রঙয়ের তো বটেই, তবে মাঝে একটু ছোপ ছোপ ধূসর দাগও আছে। কেন এমন? নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক মাঠকর্মী বললেন, আগের কিউরেটর গামিনি সিলভা উইকেট বানাতে কাটা ঘাস ব্যবহার করতেন। পরে পানি দিতেন, ভারি রোলার দিয়ে ঘনঘন রোলিং করতেন। কিন্তু এখন টনি হেমিং পুরো পদ্ধতি বদলে ফেলেছেন। এখন তিনি কেবল পানি আর ভারি রোলার দিয়ে উইকেট প্রস্তুত করছেন।
হেমিং দায়িত্বে আসার পর প্রত্যাশা ছিল, এবার হয়তো মিরপুরে ভিন্ন কিছু দেখা যাবে। তবে ওই মাঠকর্মী জানালেন, রাতারাতি উইকেটের চরিত্র আমূল বদলে ফেলা কঠিন। সেটা করতে হলে উইকেট খুঁড়ে নতুন করে তৈরি করতে হবে, যেটা অনেক সময়ের ব্যাপার। আপাতত হেমিং চেষ্টা করছেন, পুরোনো সেই ভিতের ওপর গড়ে ওঠা উইকেটকে নতুন রূপে উপস্থাপন করতে।
মৃত্তিকা বিশেষজ্ঞ হেমিং এবার উইকেটের ওপরের স্তরে ব্যবহার করেছেন নতুন মিশ্রণ, যেখানে আছে স্থানীয় মাটি, সিল্ট, আর পরিমাণ মতো কালো ‘ক্লে’। এই ক্লে তিন মাস আগে আনা হয়েছে ঢাকার পাশের এলাকা থেকে।
সেই মাঠকর্মী জানালেন, এই উইকেট হবে খানিকটা আবু ধাবি বা রাওয়ালপিন্ডির মতো। একসময় যেখানে কাজ করেছেন টনি হেমিং।
উইকেটের চেহারা কালো হলেও একটা ভিন্ন রূপ থাকবে। উইকেটের ওপরিভাগে থাকবে গ্লসিভাব। কালো হলেও তা চকচক করবে। ঘাসের ছোঁয়া তেমন থাকবে না। হেমিং আগে ওই মাঠগুলোতে কাজ করেছেন, এটা তার জন্য তেমন নতুন কিছু নয়। কিন্তু মিরপুরের চিরায়ত উইকেট থেকে এবার কিছুটা পরিবর্তন আসতে পারে বলে ইঙ্গিত দেন তিনি।
এই বদলটাই এখন মূল আলোচনার বিষয়। এত বছরেও মিরপুরের উইকেটকে সত্যিকার অর্থে ‘স্পোর্টিং’ করা যায়নি। বল এখানে পিচ করে থমকে আসে ব্যাটে, কখনও আচমকা দেখা যায় নিচু বাউন্স, কখনও থাকে অতিরিক্ত টার্ন। অনেক সময়ই উইকেটের আচরণ অননুমেয়।
একসময় এই মাঠের প্রধান কিউরেটর ছিলেন বদিউল আলম। দীর্ঘ বিরতির পর কিছুদিন আগে আবার তাকে আনা হয়েছে এই মাঠে। অভিজ্ঞ এই কিউরেটরের আশা, চেহারা কালো হলেও আচরণে ভালো হবে এই উইকেট।
“আগে কালো মাটির উইকেট হলেও কাটা ঘাস দেওয়া হতো উপরিভাগে। তাতে একটা সময় পর উইকেট ‘ড্যাম্প’ হয়ে যেত। বল নরম হলে অসম বাউন্স দেখা যেত। টনি হেমিং আসার পর সেখানে বদল আনার চেষ্টা করছেন। তিনি আগে যেসব জায়গায় কাজ করেছেন, পাকিস্তানে বা সংযুক্ত আরব আমিরাতে, সেখানেও এরকম দেখা গেছে।”
“কিংবা পার্থের কথা বলা যায় আলাদা করে। সেখানেও উইকেটের চেহারা কালো, কিন্তু বাউন্স কেমন, সবাই জানে। পার্থের মতো অতটা বাউন্স তো এখানে সম্ভব নয়। তবে মিরপুরেও উইকেট এবার ভালো হবে বলে আশা করছি।”
এই মাঠে ভালো ক্রিকেটের গল্প যতটা, তার চেয়ে বেশি বলা হয় ‘কালো’ উইকেটের গল্প। তবে এবার সেই গল্প বদলানোর ইঙ্গিত দিলেন টনি হেমিংও, “আমি তো চেষ্টা করছি… কাল থেকেই দেখতে পাবে…।”
আপনার মতামত লিখুন :