সাইফ হাসানের রান ৪৩। বাকি সব ব্যাটসম্যান আর অতিরিক্ত মিলিয়ে রান ৫০। ব্যস, বলার বাকি থাকে না আর কিছুই। হোয়াইটওয়াশ এড়ানোর লড়াইয়ে জরুরি ছিল প্রতিজ্ঞা, নিবেদন আর তাড়নার। প্রয়োজন ছিল নিজেদের ছাড়িয়ে যাওয়ার। অথচ বোলিংয়ে ব্যর্থতার পর জঘন্য ব্যাটিংয়ে বাংলাদেশ নেমে গেল নতুন তলানিতে। বিব্রতকর পারফরম্যান্সে শেষ হলো গ্লানিময় সিরিজ।
তিন ম্যাচ সিরিজের শেষটিতে ২০০ রানে হেরে হোয়াইটওয়াশড হলো বাংলাদেশ। টি-টোয়েন্টি সিরিজে ৩-০ ব্যবধানে হেরে যাওয়া আফগানিস্তান দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে প্রতিশোধ নিল ওয়ানডেতে।
আগের ম্যাচের উইকেটেই ছিল এই খেলা। সেদিন ব্যাটিংয়ে ধুঁকেছিল দুই দলই। সেই অধ্যায় পেছনে ফেলে এবার ৫০ ওভারে ২৯৩ রানের পুঁজি গড়ে আফগানরা।
সেদিনের মতোই ঠিক ৯৫ রানে আউট ইব্রাহিম জাদরান। শেষ দুই ওভারে তাণ্ডব চালিয়ে মোহাম্মাদ নাবি অপরাজিত থাকেন ৩৭ বলে ৬২ রানে।
আফগানরা বড় স্কোর গড়লেও সেই একই উইকেটে আরও বাজেভাবে মুখ থুবড়ে পড়ে বাংলাদেশ। সেদিন কোনোরকমে একশ ছাড়ানো দল এবার ২৭.১ ওভারে শেষ ৯৩ রানেই।
সাইফ ছাড়া দলের অন্য ব্যাটসম্যানদের রান টেলিফোন ডিজিটের মতো- ৭ ৩ ৭ ৬ ০ ২ ৪ ৫ ৯ ২।
ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ওয়ানডে খেলতে নেমেই ৫ উইকেট শিকার করেন তরুণ আফগান পেসার বিলাল সামি।
২০০ রানের হারে দেশের বাইরে সবচেয়ে বড় ব্যবধানে পরাজয়ের রেকর্ড স্পর্শ করল বাংলাদেশ। ২০১৭ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ইস্ট লন্ডনেও একই ব্যবধানে হেরেছিল তারা।
বাংলাদেশের বিপক্ষে পাঁচটি দ্বিপাক্ষিক সিরিজে প্রথমবার হোয়াইটওয়াশের উচ্ছ্বাস সঙ্গী হলো আফগানদের।
আগেই সিরিজ হেরে যাওয়া বাংলাদেশ একাদশ সাজায় চার পরিবর্তন নিয়ে। টস জিতে ব্যাটিং নামা আফগানিস্তানকে দারুণ শুরু এনে দেন ইব্রাহিম জাদরান ও রাহমানউল্লাহ গুরবাজ। প্রথম পাঁচ ওভারে দুজনের ব্যাট থেকে আসে ছয়টি বাউন্ডারি। সপ্তম ওভারে নাহিদ রানার বলে চোখধাঁধানো এক ফ্লিকে গুরবাজের ছক্কা ও দুই বল পর আরেকটি বাউন্ডারিতে দলের রান পেরিয়ে যায় পঞ্চাশ।
পাওয়ার প্লে শেষেও একই ছন্দে দুজনের জুটি এগিয়ে যায় শতরানের দিকে। বাংলাদেশের দুই পেসার হাসান মাহমুদ ও নাহিদ রানা ছিলেন প্রায় নির্বিষ। প্রায় আট মাস পর ওয়ানডে খেলতে নেমে গতির ঝলক দেখিয়েছিলেন নাহিদ। ১৪৫-১৪৮ কিলোমিটার গতিতে বল করেছেন নিয়মিত, ১৫০ কিলোমিটারও ছাড়িয়েছেন। কিন্তু সেই গতিতে ছিল না ধার। তার বলেই অবশ্য ৫ রানে থাকা ইব্রাহিম জীবন পান স্লিপে মোহাম্মদ নাঈম শেখের হাতে। তবে এছাড়া দুই আফগান ওপেনার রান বাড়ান অনায়াসেই।
এই জুটির পথে হাশমাতউল্লাহ শাহিদি ও রেহমাত শাহ জুটিকে পেছনে ফেলে আফগানিস্তানের সফলতম ওয়ানডে জুটি হয়ে ওঠেন ইব্রাহিম-গুরবাজ।
রানের গতিতে একটু রাশ টেনে ধরতে পেরেছিলেন যিনি, সেই তানভির ইসলামই জুটি ভাঙেন ৯৯ রানে। বাঁহাতি স্পিনারের দুর্দান্ত আর্ম ডেলিভারিতে এলবিডব্লিউ হন গুরবাজ (৪৪ বলে ৪২)।
ইব্রাহিম এরপর আরেকটি কার্যকর জুটি গড়ে তোলেন সেদিকউল্লাহ আটালকে নিয়ে। ২৫ ওভারে ১৫০ ছুঁয়ে এগিয়ে যায় আফগানিস্তান।
জুটি ভাঙতে সাইফ হাসানকে আক্রমণে আনেন অধিনায়ক মেহেদী হাসান মিরাজ। এটি কাজে লেগে যায় জাদুমন্ত্রের মতো। রাউন্ড আর্ম অ্যাকশনের অফ স্পিনে কোনো রান দেওয়ার আগেই দুটি উইকেট নিয়ে নেন তিনি। আলতো করে ফিরতি ক্যাচ দিয়ে ফেরেন আটাল (৪৭ বলে ২৯)। তার পরের ওভারে মিড উইকেট সীমানায় ক্যাচ দেন আফগান অধিনায়ক শাহিদি (২)।
এরপর আফগানদের আরও চেপে ধরে বাংলাদেশ। আগের ম্যাচে ৯৫ রানে সীমানায় ক্যাচ দেওয়া ইব্রাহিম এবার একই রানে রান আউটে কাটা পড়েন নাহিদ রানার সরাসরি থ্রোয়ে। রেহমাতের চোটে সুযোগ পাওয়া ইকরাম আলিখিলকে বিদায় করেন সাইফ।
পাল্টা আক্রমণে শুরু করা আজমাতউল্লাহ ওমারজাইকে (২০) দুর্দান্ত টার্নিং ডেলিভারিতে বোল্ড করেন তানভির। প্রথম বলে ছক্কায় শুরু করে রাশিদ খান উইকেট বিলিয়ে দেন ৮ রানেই।
৭৩ বলে ৪৮ রানের মধ্যে ৬ উইকেট হারায় আফগানরা। এক পর্যায়ে টানা ৬১ বলে আসেনি কোনো বাউন্ডারি।
টালমাটাল সেই ইনিংসকে কিছুটা থিতু করেন নাবি ও নানগেয়ালিয়া খারোটে। ৪৮তম ওভারে হাসান মাহমুদ যখন টানা দুই বলে বোল্ড করেন খারোটে ও এএম গাজানফারকে, আফগানদের ২৫০ রানে আটকে রাখার আশা তখন ছিল বাংলাদেশের।
সব ওলটপালট হয়ে যায় পরের দুই ওভারে।
প্রথম দুই বলে এক রান দেওয়ার পর একটি ওয়াইড ডেলিভারি করে চোট নিয়ে মাঠ ছাড়েন নাহিদ। ওভারটি শেষ করতে এসে তুলাধুনার শিকার হন মিরাজ। তাকে তিনটি বিশাল ছক্কায় উড়িয়ে দেন নাবি। ওভার থেকে আসে ২৫ রান।
শেষ ওভারে হাসানকেও শিক্ষা দেন নাবি। তিন চার এক ছক্কায় ওই ওভার থেকে আসে ১৯ রান।
এক পর্যায়ে ২৭ বলে ২৫ রানে থাকা নাবি পরের ১০ বলে করেন ৩৭ রান।
শেষ দুই ওভারে ৪৪ রান নিয়ে ২৯০ পেরিয়ে যায় আফগানরা।
এই রান তাড়া করতে হলে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের ছাড়িয়ে যেতে হতো নিজেদের। কিন্তু এই সিরিজে তো তারা নিজেদের ছায়া হয়েই আছেন!
ঘরোয়া ক্রিকেটে রানের জোয়ার বইয়ে দিয়ে দুই বছর পর ওয়ানডে খেলতে নামা নাঈম যন্ত্রণাময় উপস্থিতি শেষে আউট হন ২৪ বলে ৭ রান করে।
সিরিজে প্রথম খেলতে নামা বিলাল সামির বল স্টাম্পে টেনে আনা নাজমুল হোসেন শান্ত ৩ রান করেন ১৬ বল খেলে।
সাইফ হাসান দারুণ কয়েকটি শটে চার-ছক্কা মারলেও বাকি সময়টায় ছিলেন ঝিমিয়ে। সিঙ্গল বের করতে পারেননি খুব একটা।
১৫ ওভারে বাংলাদেশ তুলতে পারে কেবল ৫৬ রান।
সপ্তদশ ওভারে রাশিদ আক্রমণে আসতেই আরও এলোমেলো হয়ে পড়ে ইনিংস। শুরু করেন তিনি প্রথম বলেই গুগলি করে। পুরোপুরি বিভ্রান্ত হয়ে বোল্ড তাওহিদ হৃদয়।
রাশিদের পরের ওভারেই আরেকটি দুর্দান্ত গুগলিতে বোল্ড সাইফ। তিন ছক্কা ও দুটি চার মারার পরও তার ৪৩ রান আসে ৫৪ বলে।
অধিনায়ক মিরাজ আলগা শটে আউট হন বিলাল সামির বলে। পরের বলেই আলসে ভঙ্গিতে রান আউট হন শামীম হোসেন। রাশিদের গুগলিতেই এলবিডব্লিউ নুরুল হাসান সোহান। এরপর লোয়ার অর্ডারও ভেঙে পড়ে দ্রুতই।
শেষ তিনটি উইকেট নিয়ে পাঁচ উইকেট পূর্ণ করেন বিলাল সামি। ম্যাচ-সেরার পুরস্কার পান ২১ বছর বয়সী পেসার। তিন উইকেট নিয়ে রাশিদ স্পর্শ করেন তিন ম্যাচের সিরিজে ১১ উইকেটের বিশ্বরেকর্ড। ব্যাটিংয়ের জন্য কঠিন উইকেটে দারুণ ব্যাটিংয়ে সিরিজ-সেরা হন ইব্রাহিম জাদরান।
এই হতাশা পেছনে ফেলতে খুব বেশি সময় পাচ্ছে না বাংলাদেশ। শনিবার থেকেই দেশের মাঠে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
আফগানিস্তান: ৫০ ওভারে ২৯৩/৯ (গুরবাজ ৪২, ইব্রাহিম ৯৫, আটাল ২৯, শাহিদি ২, আলিখিল ২, ওমারজাই ২০, নাবি ৬২*, রাশিদ ৮, খারোটে ১০, গাজানফার ০, সামি ০*; নাহিদ ৮.২-০-৫৬-০, হাসান ৬-০-৫৭-২, তানভির ১০-০-৪৬-২, মিরাজ ৯.৪-০-৬৭-১, রিশাদ ১০-০-৪৩-০, শামীম ২-০-১২-০, সাইফ ৪-১-৬-৩)।
বাংলাদেশ: ২৭.১ ওভারে ৯৩ (সাইফ ৪৩, নাঈম ৭, শান্ত ৩, হৃদয় ৭, মিরাজ ৬, শামীম ০, সোহান ২, রিশাদ ৪, তানভির ৫, হাসান ৯, নাহিদ ২*; ওমারজাই ৬-০-২০-১, গাজানফার ৭-০-২৫-০, সামি ৭.১-০-৩৩-৫, খারোটে ১-০-৩-০, রাশিদ ৬-১-১২-৩)।
ফল: আফগানিস্তান ২০০ রানে জয়ী।
সিরিজ: তিন ম্যাচ সিরিজে আফগানিস্তান ৩-০ ব্যবধানে জয়ী।
ম্যান অব দা ম্যাচ: বিলাল সামি।
ম্যান অব দা সিরিজ: ইব্রাহিম জাদরান।
আপনার মতামত লিখুন :