পিতামাতা হওয়া সহজ কাজ নয়। বিশেষ করে নতুন বাবা-মায়ের জন্য সন্তানের কান্নার কারণ বোঝা, প্রতিদিন ছোট-বড় নানান সিদ্ধান্ত নেওয়া এক বিশাল চ্যালেঞ্জ। এর সঙ্গে যোগ হয় অনেক প্রশ্ন।
এছাড়া বিভিন্ন রকম বিভ্রান্তিকর পরামর্শও পাওয়া যায়। তখন সঠিক দিকনির্দেশনা অত্যন্ত জরুরি।
যুক্তরাষ্ট্রের শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. ডেভিড হিল সম্প্রতি সিএনএন ডটকম-এর সঙ্গে এক আলোচনায় বলেন, “শিশুর যত্নের পরামর্শ সময়ের সঙ্গে বদলেছে। একসময় যে বিষয়গুলোকে সঠিক ধরা হতো, বিজ্ঞানের অগ্রগতির কারণে আজ তা পরিবর্তিত হয়েছে।”
ডা. হিল উল্লেখ করেন, “আমি যে অভিভাবকদের সন্তানদের ছোটবেলায় দেখেছি, তাদেরই এখনকার সন্তানদের জন্য মাঝে মাঝে আগের থেকে একেবারেই উল্টো কথা বলতে হয়।”
তার অভিজ্ঞতায় শিশু যত্নের ক্ষেত্রে পাঁচটি বড় পরিবর্তন এসেছে।
নিরাপদ ঘুমের নিয়ম
শিশুর ঘুম নিয়ে ধারণা একসময় সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল।
ডা. হিল বলেন, “১৯৯৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব চাইল্ড হেল্থ অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট’ ‘ব্যাক টু স্লিপ’ প্রচারণা শুরু করে। তার আগে অভিভাবকদের বলা হতো শিশুকে পেটের ওপর শোয়াতে, যাতে দুধ উঠলে শ্বাসরোধ না হয়। তবে গবেষণায় প্রমাণিত হয়, শিশুকে পিঠের ওপর শোয়ালে হঠাৎ মৃত্যুর ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়।”
২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ‘কনজিউমার প্রোডাক্ট সেফটি কমিশন’ ড্রপ-সাইড খাট নিষিদ্ধ করে। ২০১৯ সালে ঢালু শোয়ানোর আসবাব বন্ধ হয়।
পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৯০ সালে প্রতি এক লাখ শিশুর মধ্যে ১৫৪ জন হঠাৎ মৃত্যুর শিকার হত। নিরাপদ ঘুমের প্রচারণার কারণে ২০১১ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৮৬-তে। যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিছুটা বেড়ে ২০২২ সালে হয়েছে ১০০।
ডা. হিলের মতে, সঠিক নিয়ম মানলে অনেক মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব।
খাবারের অ্যালার্জি প্রতিরোধে নতুন ধারণা
অনেক বছর ধরে শিশুদের অ্যালার্জি ঠেকাতে বাদাম, ডিম বা এমন খাবার থেকে দূরে রাখার পরামর্শ দেওয়া হতো।
তবে ২০১৫ সালে যুক্তরাজ্যে প্রকাশিত বিখ্যাত ‘লিপ ট্রায়াল’ গবেষণায় দেখা যায়, এভাবে দূরে রাখার কারণেই অ্যালার্জির ঝুঁকি বেড়ে গিয়েছিল।
ডা. হিল বলেন, “চিকিৎসকদের পুরানো নির্দেশনা ফেলে দিতে হয়েছিল, কারণ সেগুলো উল্টো ক্ষতি করছিল।”
এখন পরামর্শ হলো— শিশু যখন ছয় মাস বয়সে শক্ত খাবার খাওয়া শুরু করে, তখনই সামান্য পরিমাণে বাদাম ও ডিমসহ সম্ভাব্য অ্যালার্জির খাবারও খাওয়ানো উচিত। এতে শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে।”
নাভির যত্নে পরিবর্তন
আগে শিশু জন্মের পর নাভি শুকানোর জন্য বেগুনি রংয়ের অ্যান্টিসেপটিক ‘ট্রিপল ডাই’ ব্যবহার করা হত। পরে অ্যালকোহল ব্যবহারের প্রবণতা আসে।
তবে ধীরে ধীরে প্রমাণিত হয়, নাভি শুকিয়ে যাওয়াই যথেষ্ট। তাই বর্তমানে ভালো পরিবেশে জন্ম নেওয়া শিশুর ক্ষেত্রে কোনো ওষুধ ব্যবহার না করে শুধু শুকনো রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়।
ডা. হিল বলেন, “নাভির চারপাশ লাল হয়ে গেলে বা দুর্গন্ধযুক্ত তরল বের হলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া জরুরি। তবে স্নান করানো নিয়ে দ্বিধা থাকলেও, সংক্ষিপ্ত গোসল আসলে তেমন ক্ষতি করে না।”
নতুন ও উন্নত টিকা
শিশুদের জন্য টিকার তালিকা গত কয়েক দশকে বড় ধরনের পরিবর্তন দেখেছে।
ডা. হিল জানান, তার বাবাও ছিলেন শিশু বিশেষজ্ঞ। তখন ‘হামোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা বি ব্যাক্টেরিয়া’র কারণে মেনিনজাইটিস ও সেপসিস রোগে বহু শিশু মারা যেত। ১৯৮৫ সালে টিকা আসার পর এসব রোগ দ্রুত কমতে থাকে।
২০০০ সালে শিশুদের জন্য ‘নিউমোকক্কল টিকা’ চালু হলে নিউমোনিয়ার ঝুঁকি নাটকীয়ভাবে কমে যায়। প্রথমে ৭ প্রকার জীবাণুর বিরুদ্ধে কাজ করলেও বর্তমানে ২৩ প্রকার পর্যন্ত প্রতিরোধ দেয়।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শ্বাসতন্ত্রের মারাত্মক রোগ আরএসভি (আরএসভি)–এর টিকা ও অ্যান্টিবডি ইঞ্জেকশন চালু হওয়ায় শিশুর মৃত্যু ও জটিলতা অনেক কমেছে।
শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য ও ‘ট্রমা-ইনফর্মড কেয়ার’
১৯৯৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রকাশিত ‘অ্যাডভার্স চাইল্ডহুড এক্সপেরিয়েন্সেস স্টাডি’ চিকিৎসকদের ভাবনার জগৎ বদলে দেয়।
গবেষণায় দেখা যায়- ছোটবেলায় নির্যাতন, অভিভাবকের মৃত্যু, মানসিক রোগ বা মাদকাসক্ত পরিবেশ— এসব অভিজ্ঞতা মস্তিষ্কের বিকাশ ও ভবিষ্যতের শারীরিক-মানসিক স্বাস্থ্যে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে।
এরপর থেকেই শিশু বিশেষজ্ঞরা শুধু শারীরিক অসুখ নয় পাশাপাশি মানসিক চাপ ও পারিবারিক পরিবেশকেও গুরুত্ব দিতে শুরু করেন।
ডা. হিল বলেন, “এখন আমরা জিজ্ঞেস করি না ‘তোমার কী সমস্যা?’ বরং বলি, ‘তোমার কী অভিজ্ঞতা হয়েছে, আর আমরা কীভাবে সাহায্য করতে পারি?’”
তিনি আরও বলেন, “প্রতিটি শিশুই কোনো না কোনো চাপের মুখে পড়ে। তবে নিরাপদ, স্থিতিশীল ও ভালোবাসায় ভরা সম্পর্ক শিশুদের রক্ষা করতে পারে।”
এখান থেকেই এসেছে ‘যথেষ্ট ভালো অভিভাবক’ ধারণা— যেখানে পরিপূর্ণতা নয়, বরং সন্তানের প্রতি যত্ন ও স্থিতিশীল পরিবেশই সবচেয়ে জরুরি।
আরও পড়ুন
চাপ না দিয়ে শিশুর সঙ্গে আবেগ নিয়ে কথা বলার উপায়
আপনার মতামত লিখুন :