সুস্থ জীবনের জন্য সাধারণত খাবার, চিকিৎসা, ব্যায়াম বা মানসিক প্রশান্তির কথা বলা হয়। তবে বাসস্থান বা ঘর স্বাস্থ্যের ওপর কতটা প্রভাব ফেলে, সে বিষয়ে আলোচনা তুলনামূলকভাবে কম হয়।
বাস্তবে ঘরের মান, নিরাপত্তা, অবস্থান ও স্থায়িত্ব সবই শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত।
বাসস্থানের মান ও স্বাস্থ্যের প্রভাব
মেডিকেলনিউজটুডে ডটকম’য়ে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে জানানো হয়, ঘরের ভেতরের পরিবেশগত উপাদান, যেমন- বাতাসের মান, পর্যাপ্ত জায়গা, ছত্রাক, ‘অ্যাসবেস্টস’ বা সিসার উপস্থিতি, এমনকি ঘরের ভেতরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণও মানুষের স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, নিম্নমানের ঘর নানান ধরনের দীর্ঘস্থায়ী অসুখ, আঘাত কিংবা মানসিক চাপ বাড়ায়।
ঘরের গরম বা ঠাণ্ডা রাখার যন্ত্র, পানির পাইপলাইন বা বাতাস প্রবাহ ব্যবস্থা যদি দুর্বল হয় তবে তা কার্বন মনোক্সাইডের মতো ক্ষতিকর গ্যাস বা বায়ুবাহিত রোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
আবার ছত্রাক বা ফাঙ্গাস শ্বাসযন্ত্রের ক্ষতি করে, যা হাঁপানি ও অন্যান্য শ্বাসকষ্টজনিত রোগের কারণ হতে পারে।
নিম্ন আয়ের পরিবার ও ঝুঁকি
প্রতিবেদনে আরও জানানো হয়, নিম্ন আয়ের মানুষরাই সবচেয়ে বেশি নিম্নমানের বাসস্থানে বসবাস করেন। ঘর ছোট বা অতিরিক্ত মানুষ থাকলে সেখানে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা বাড়ে, খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয়। এমনকি সংক্রামক রোগও দ্রুত ছড়ায়।
যুক্তরাষ্ট্রের ‘দ্য স্টেট অব দ্য নেইশন্স হাউজিং ২০১৮’র প্রতিবেদনে দেখা যায়, উচ্চ ভাড়ার কারণে অনেক পরিবার তাদের মৌলিক স্বাস্থ্য প্রয়োজন মেটাতে ব্যর্থ হয়। ফলে পুষ্টিকর খাবার, চিকিৎসা বা ঘরের রক্ষণাবেক্ষণের মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যয় উপেক্ষিত হয়।
সামাজিক ও পরিবেশগত প্রভাব
নিম্নমানের ঘরে বসবাস মানেই কেবল চার দেয়ালের ভেতরে সমস্যায় সীমাবদ্ধ থাকা নয়, বরং আশপাশের পরিবেশও স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ায়।
নিম্ন আয়ের এলাকাগুলোতে সাধারণত কম সুবিধা থাকে। ভালো স্কুল, স্বাস্থ্যসেবা, পরিবহন বা নিরাপদ কর্মসংস্থান সেখানে দুর্লভ। ফলে মানুষ আর্থিক স্থিতি গড়তে পারে না এবং অপরাধপ্রবণতার মুখোমুখি হয়।
২০২০ সালে প্রকাশিত ‘বস্টন ইউনিভার্সিটি স্কুল অফ পাবলিক হেল্থ’য়ের করা গবেষণায় দেখা যায়, কোভিড-১৯ মহামারির সময় নিম্ন আয়ের এলাকায় বসবাসকারীরা নিরাপদে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা পাননি।
ফলে তাদের মধ্যে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার বেশি
ঘরের মানের চারটি ঝুঁকির ধরন
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা ঘরের ভেতরের ঝুঁকিকে চার ভাগে ভাগ করেছেন।
জীববৈজ্ঞানিক ঝুঁকি
যেমন- ছত্রাক, ইঁদুর বা ধুলিকণা, যা অ্যালার্জি ও হাঁপানির ঝুঁকি বাড়ায়।
রাসায়নিক ঝুঁকি
যেমন- সিসা, অ্যাসবেস্টস, রাডন এবং কার্বন মনোক্সাইড। এগুলো স্নায়বিক জটিলতা, ক্যানসার ও শ্বাসজনিত রোগ সৃষ্টি করে।
শারীরিক ঝুঁকি
যেমন: বায়ু চলাচলের সমস্যা, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা বা ঘরের ভেতরের আঘাতের ঝুঁকি।
সামাজিক ঝুঁকি
যেমন- অতিরিক্ত লোক, দারিদ্র্য বা অপরাধভীতি, যা মানসিক চাপ ও সংক্রামক রোগের বিস্তার ঘটায়।
স্থায়িত্ব ও নিরাপত্তা
শুধু মান নয়, বাসস্থানের স্থায়িত্বও স্বাস্থ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত।
যদি ঘর ভেঙে পড়ার মতো ঝুঁকি তৈরি হয় বা ভাড়া দেওয়ার অনিশ্চয়তা থাকে তবে সেটা মানসিক অস্থিরতা বাড়ায়।
গৃহহীন মানুষরা মানসিক অসুস্থতা, সংক্রামক রোগ, সহিংসতা ও মাদকাসক্তির উচ্চ ঝুঁকিতে থাকেন। তাদের জন্য প্রতিদিনের জীবন কেবল টিকে থাকার লড়াই।
শারীরিক অসুস্থতার সঙ্গে সম্পর্ক
নিম্নমানের ঘর শুধুমাত্র মানসিক নয়, সরাসরি শারীরিক অসুস্থতার ঝুঁকিও বাড়ায়।
ঘরের তাপমাত্রা ওঠা-নামার প্রভাবে রক্তচাপ বাড়িয়ে হৃদ্রোগের ঝুঁকি সৃষ্টি করে। আবার ছাদের পানি চুঁইয়ে পড়লে ছত্রাক হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, যা ফুসফুসের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
গবেষণা বলছে, খারাপ আবাসন অবস্থা মানুষের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাকে দুর্বল করেছে এবং জটিলতা বাড়িয়েছে।
তাই স্বাস্থ্য ভালো রাখতে ঘরের পরিবেশও স্বাস্থ্যকর রাখার প্রয়োজন।
আরও পড়ুন
আপনার মতামত লিখুন :