পৃথিবীর পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে উদ্বেগ আজ আর কেবল গবেষক কিংবা পরিবেশবিদদের আলোচনার বিষয় নয়, বরং সাধারণ মানুষের প্রতিদিনের মানসিক স্বাস্থ্যের অংশ হয়ে উঠছে।
বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, দাবানল, খরা কিংবা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি— এসব ঘটনা মানুষের জীবনে স্থায়ী অনিশ্চয়তা ও ভয়ের জন্ম দিচ্ছে। গবেষকরা এই উদ্বেগকে নাম দিয়েছেন ‘ইকো-অ্যাংজাইটি’।
ইকো-অ্যাংজাইটি বলতে যা বোঝায়
মেডিকেলনিউজটুডে ডটকম-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে- ২০১৭ সালে ‘আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন’ একে সংজ্ঞায়িত করে বলেছে, ‘ইকো-অ্যাংজাইটি’ হল ‘পরিবেশগত ধ্বংসের দীর্ঘস্থায়ী ভীতি’।
যদিও মানসিক রোগ নির্ণয়ের আনুষ্ঠানিক নির্দেশিকা (ডায়াগোনস্টিক অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিক্যাল ম্যানুয়াল অফ মেন্টাল ডিজঅর্ডার বা ডিএসএম-৫)-এ এটিকে আলাদা কোনো অসুখ হিসেবে উল্লেখ করা হয়নি, তবে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা স্বীকার করছেন, এটির প্রভাব বাস্তব এবং ক্রমেই বাড়ছে।
‘ইকো-অ্যাংজাইটি’ মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। যেমন- হতাশা, ঘুমের সমস্যা, রাগ, অসহায়ত্ববোধ কিংবা তীব্র মানসিক চাপ।
যে কারণে তৈরি হয় এই উদ্বেগ
২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে পরিচালিত একটি জাতীয় জরিপে দেখা যায়, প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে উদ্বিগ্ন এবং প্রায় ৫১ শতাংশ মানুষ নিজেদের ‘অসহায়’ মনে করেন।
গবেষণায় উঠে আসা পরিবেশগত ধ্বংস বা ঝুঁকির কারণগুলো হল— অত্যধিক তাপমাত্রা, ঘূর্ণিঝড়, বনভূমি ধ্বংস, কৃষিজমি নষ্ট হয়ে যাওয়া কিংবা জীবিকার নিশ্চয়তা হারানো।
কেবল সরাসরি প্রাকৃতিক দুর্যোগই নয় গণমাধ্যমে পরিবেশ ধ্বংসের খবর, তথ্য বা চিত্রও মানুষের মানসিক চাপে ভূমিকা রাখে।
বিশেষ করে যারা নিজেরা কোনো ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছেন বা প্রিয়জনদের ঝুঁকিতে দেখেছেন, তাদের উদ্বেগ আরও প্রবল হয়।
‘আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন’ উল্লেখ করেছে- জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মানুষ ট্রমা, পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার (পিটিএসডি), মাদকাসক্তি বা আত্মনিয়ন্ত্রণের অভাবেও ভুগতে পারে।
যারা বেশি ভোগে
পরিবেশগত ক্ষতি সবার ওপর সমানভাবে প্রভাব ফেলে না। উপকূলীয় বা নিচু এলাকার বাসিন্দারা, যেমন- ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে বেশি ঝুঁকিতে থাকেন তেমনি কৃষি, মৎস্য বা পর্যটন-নির্ভর জীবিকার সঙ্গে যুক্ত মানুষদের উদ্বেগও বেশি।
স্থানীয় আদিবাসী সম্প্রদায়রা প্রকৃতির ওপর সরাসরি নির্ভরশীল হওয়ায় তাদের সংস্কৃতি ও অস্তিত্ব টিকে থাকার প্রশ্নে হুমকির মুখে পড়ে।
এছাড়া পরিবেশ রক্ষায় কাজ করা কর্মী, জরুরি স্বাস্থ্যসেবাদানকারী বা প্রথম প্রতিক্রিয়াকারী কর্মীরা সরাসরি ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি হওয়াতে মানসিক চাপে ভোগেন। শিশু ও তরুণদের মধ্যেও ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ‘ক্লাইমেট সাইকোলজি অ্যালায়েন্স’ জানিয়েছে- তরুণ প্রজন্ম বিশেষভাবে এই মানসিক চাপ অনুভব করছে, কারণ তাদের দীর্ঘমেয়াদী ভবিষ্যৎই সবচেয়ে অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে।
নিজে কি ইকো-অ্যাংজাইটিতে ভুগছি?
এটি নির্ণয়ের জন্য কোনো চিকিৎসাবিদ্যা-স্বীকৃত মানদণ্ড নেই। তবে যদি পরিবেশ নিয়ে উদ্বেগ নিজের স্বাভাবিক কাজ, পড়াশোনা, পারিবারিক দায়িত্ব বা ব্যক্তিগত সুস্থতায় বাধা সৃষ্টি করে তবে সেটি ইকো-অ্যাংজাইটির লক্ষণ হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রে এখন অনেক মনোবিদ এই বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। তাদের মতে, সচেতন উদ্বেগ আর অস্বাস্থ্যকর উদ্বেগের মধ্যে সীমারেখা টানা জরুরি।
যেভাবে সামলানো যায়
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন রোধের মূল দায়িত্ব সরকারের, আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বহুজাতিক কর্পোরেশনের।
তবে ব্যক্তিগত পর্যায়ে মানুষ কিছু পদক্ষেপ নিলে মানসিক চাপ কমাতে পারে।
প্রথমত, ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ। পরিবেশবান্ধব আচরণ, যেমন- পুনর্ব্যবহার (রিসাইকেল), টেকসই খাদ্যাভ্যাস বা কোনো পরিবেশ সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হওয়া। এসব কর্মকাণ্ডে মানুষ অসহায়ত্ব কাটিয়ে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে।
দ্বিতীয়ত, সঠিক তথ্য সংগ্রহ। বিভ্রান্তিকর তথ্য উদ্বেগ বাড়ায়, অথচ নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে পরিবেশ সম্পর্কে জেনে রাখা মানসিক দৃঢ়তা বাড়ায়।
তৃতীয়ত, সহনশীলতা বা ‘রেজিলিয়েন্স’ গড়ে তোলা। ‘আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন’ জানায়- যারা নিজেদের সক্ষমতায় বিশ্বাস রাখেন, তারা প্রাকৃতিক দুর্যোগ-পরবর্তী সময়ে মানসিক আঘাত থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসতে পারেন।
পরিবার, বন্ধু বা সম্প্রদায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক মানসিক চাপ কমাতে সহায়ক।
চতুর্থত, প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করা। নিয়মিত প্রকৃতির সান্নিধ্যে থাকা, যেমন- বাগানে সময় কাটানো বা হাঁটাহাঁটি করা, মানসিক প্রশান্তি আনে। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, প্রকৃতির কোনো বস্তু যেমন একটি পাথর বা শুকনো ফুল কাছে রাখা উদ্বেগের মুহূর্তে মানসিক স্থিতি ফিরিয়ে আনতে পারে।
পঞ্চমত, শারীরিক কার্যকলাপ বৃদ্ধি। নিয়মিত হাঁটা, দৌড়ানো বা সাইকেল চালানো মানসিক চাপ কমানোর পাশাপাশি পরিবেশ দূষণ হ্রাসেও অবদান রাখে।
ষষ্ঠত, অতিরিক্ত তথ্য থেকে বিরত থাকা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা সংবাদ-মাধ্যমে লাগাতার নেতিবাচক তথ্য দেখা উদ্বেগ বাড়াতে পারে। তাই মাঝে মাঝে এসব থেকে দূরে থাকা বা নির্ভরযোগ্য মাধ্যম বেছে নেওয়া প্রয়োজন।
আরও পড়ুন
আপনার মতামত লিখুন :